নিরাপদ সবজি আবাদের চর্চা বাড়ছে সারা দেশে

সাইদ শাহীন

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নং নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মোস্তবাপুর গ্রামের শতাধিক কৃষক উৎপাদন করছেন বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন, প্রক্রিয়াকরণ মজুদের সব পর্যায়েই জৈব নিরাপদ উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে গ্রামটিতে উৎপাদিত নিরাপদ সবজির চাহিদা এখন স্থানীয় বাজার থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে রাজধানীতেও

নিরাপদ সবজি উৎপাদনের চর্চাটি মোস্তবাপুর গ্রাম থেকে ছড়িয়েছে আশপাশের গ্রামগুলোয়ও সব মিলিয়ে নং নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ২৩টি গ্রামে এখন নিরাপদ সবজি উৎপাদন হচ্ছে গোটা ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার কিষান-কিষানি নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করছেন জৈব কেঁচো কম্পোস্ট সার জৈব বালাইনাশক উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের সিংহভাগই নারী তাদের উৎপাদিত পণ্য স্থানীয়ভাবে বিক্রির জন্য গড়ে তোলা হয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি বাজার প্রতি বৃহস্পতিবার ইউনিয়নের পূর্ব বলরামপুর গ্রামে বাজার বসছে, স্থানীয়রা যার নাম দিয়েছে বিষমুক্ত সবজির বউবাজার

খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের গুরুত্ব এখন অনুভূত হচ্ছে সমানভাবেই কৃষি খাতে প্রাযুক্তিক প্রগতির কল্যাণে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই কিন্তু এর পরও নিরাপদ খাদ্যের প্রাপ্যতাকে অনিশ্চিত করে তুলছে কীটনাশক রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে ভোক্তা থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত সব মহলকেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের দাবি এখন বাংলাদেশেও বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে এখন পর্যন্ত পুষ্টিমানসম্পন্ন নিরাপদ সবজি উৎপাদন বিপণনে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও এর সিংহভাগই ছিল বেসরকারি পর্যায়ে অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে নিয়ে ব্যাপক সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হয়নি এতদিন তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ও এখন উদ্যোগহীনতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে এরই ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সারা দেশের সব উপজেলায় অন্তত একটি করে নিরাপদ সবজি গ্রাম গড়ে তোলার

সংশ্লিষ্টরা জানান, উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো ভোক্তা পর্যায়ে নিরাপদ সবজির সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষকদের বাণিজ্যিকভাবে লাভবান করা এজন্য প্রত্যেক উপজেলায় অন্তত একটি সুবিধাজনক গ্রাম বাছাই করে সেখানে কৃষক গ্রুপ গড়ে তোলা হবে এসব কৃষককে দেয়া হবে আলাদা প্রশিক্ষণ, অর্থনৈতিক সহায়তাসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধা এরপর তা পর্যায়ক্রমে গ্রামের সব কৃষকের মধ্যে সম্প্রসারণ করা হবে একই সঙ্গে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে উৎপাদিত নিরাপদ সবজি বিপণনের দিকেও এসব সবজির বিক্রি নিশ্চিত করতে জেলা পর্যায়ে গড়ে তোলা হবে নিরাপদ কৃষিবাজার এছাড়া রাজধানীর বড় বাজারগুলোর পাশে স্থাপন করা হবে নিরাপদ সবজি কর্নার এভাবে উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নিরাপদ সবজির চাহিদা বাড়ায় সারা দেশেই এর উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে একই সঙ্গে আমরা ভোক্তাদের মধ্যে নিরাপদ সবজির ভোগ আকাঙ্ক্ষা তৈরির পাশাপাশি তা দ্রুত সরবরাহ করতে কাজ করছি এজন্য আমরা প্রতিটি উপজেলায় নিরাপদ সবজি গ্রাম তৈরি করছি ধীরে ধীরে দেশের সব উপজেলায় নিরাপদ সবজি কর্নার তৈরি করা হবে রাজধানীর সেচ ভবনের প্রাঙ্গণে প্রতি শুক্র শনিবার কৃষকের বাজার বসছে বাজারের সব সবজি নিরাপদ পরীক্ষার মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে কারণ সবজি যদি নিরাপদ পুষ্টিকর না হয়, তবে তা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন ক্ষতিকর কীটনাশকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার একেবারেই বন্ধ করে বিকল্প জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে যদি কীটনাশক ব্যবহার করতেই হয়, সেক্ষেত্রে ফসল সংগ্রহ তা ভোক্তার টেবিলে পৌঁছার আগে নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ করতে হবে এছাড়া রাসায়নিক সার ব্যবহার কমিয়ে বাড়াতে হবে জৈব সার ব্যবহার পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ বিপণন ব্যবস্থায় ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে

বেসরকারি পর্যায়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদন সম্প্রসারণে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান দুই দশক ধরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নিয়ামতপুর ইউনিয়ন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৩০টির বেশি গ্রামে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি এজন্য জৈব সার, বিশেষ করে কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন, জৈব বালাইনাশক, ইমো (ইকো মাইক্রো অর্গানিজম) তৈরির প্রক্রিয়ার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বীজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের পাশাপাশি উৎপাদিত নিরাপদ সবজি সংরক্ষণ বিপণন নিয়েও কিষান-কিষানিদের অর্গানিক কৃষিতে সম্পৃৃক্ত করার পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে কৃষক সমবায় সমিতি বর্তমানে নিরাপদ অর্গানিক কৃষি বাণিজ্যে সফলতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অঞ্চল দুটি

সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে কিষান-কিষানিরা কীটনাশক রাসায়নিক সারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে নিজেরা সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও সচেতন করতে পারেন এর প্রমাণ মিলেছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নিয়ামতপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলোয় মোস্তবাপুর গ্রামের কিষানি মনোয়ারা বেগম বলেন, রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে মাটির উর্বরা শক্তি হারিয়ে যায় কিন্তু জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে একদিকে মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ে, অন্যদিকে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন করা যায় এজন্য নিজে জৈব সার বালাইনাশক তৈরি করছি নিরাপদ সবজি আবাদ করছি অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করেছি উৎপাদন খরচ কম আবার বেশি দামে বিক্রিও করতে পারছি এরই মধ্যে উৎপাদিত নিরাপদ সবজি রাজধানীতে পাঠানো শুরু করেছি

পোকা দমনে কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই সফলতা পেয়েছেন মানিকগঞ্জের কৃষক দেলোয়ার জাহান গন্ধে আকৃষ্ট নানা ধরনের পোকার জন্য ক্ষেতের আইলে বা আশপাশে বিকট গন্ধযুক্ত ছোট গাছপালা, বিশেষ করে ছোট ছোট বুনো তামাক লাগিয়ে সেগুলো প্রতিরোধ করে থাকেন তিনি অন্যদিকে যেসব পোকা রস খেতে আসে, সেগুলোকে প্রতিরোধের জন্য তিতা স্বাদের ফলের রস জমিতে স্প্রে করছেন তার উপলব্ধি, একই এলাকায় একই ধরনের শস্যের আবাদ বিশেষ ধরনের পোকার আক্রমণ ডেকে আনতে পারে কারণে নিজ এলাকার কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শস্য আবাদে বৈচিত্র্য এনেছেন তিনি

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক কৃষির সমন্বয়ক দেলোয়ার জাহানের মতে, সব পোকাকে না মেরেও শস্যের ক্ষতি কমানো সম্ভব শস্য আবাদে এবং পোকা দমনেও ভুল পদ্ধতি প্রয়োগের কারণেই কীটনাশকের ব্যাপকতা বাড়ছে

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, জীববৈচিত্র্যে সব পোকাই ক্ষতিকারক নয় ফলে সব পোকা মারার প্রয়োজনও নেই আবার ক্ষতিকর বালাইনাশক ব্যবহারে মাটির ভেতরের উপরের জীবের পাশাপাশি জলজ জীবগুলোর কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, সে বিষয়ে কার্যকর কোনো গবেষণা নেই জমির বালাইগুলোকে ধ্বংস না করে বরং প্রতিরোধের মানসিকতা গড়ে তোলা গেলে অ্যাগ্রো ইকোলজি ঠিক রাখা সম্ভব পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক উপায়ই রয়েছে বালাইনাশকের বিকল্প যেসব পথ উপায় রয়েছে, সেগুলো কৃষকের মধ্যে সম্প্রসারণ করতে হবে

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিরাপদ সবজি উৎপাদন বাড়াতে হলে অবশ্যই কীটনাশকের অবাধ বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে এছাড়া বিকল্প জৈব সার বালাইনাশক উৎপাদন বাড়াতে হবে তাহলেই সারা দেশে নিরাপদ সবজি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে

বিষয়ে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক সংগঠন বিসেফ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান মিটন বণিক বার্তাকে বলেন, কীটনাশক বা বিষ ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ব্যবহার বাড়াতে হলে নতুন গবেষণা উদ্ভাবন প্রয়োজন সারের চাহিদা মেটানো গেলেও বালাইনাশকের চাহিদা শতভাগ পূরণ করা সম্ভব হয় না এজন্য আইপিএম কিংবা আইসিএম কার্যক্রমগুলোকে প্রকল্পভিত্তিক না করে নিয়মিত করতে হবে বিকল্প বালাইনাশক তৈরি, বিশেষ করে ফেরোমেন ট্র্যাপ (আলোর ফাঁদ) বা অন্য কোনো পন্থা অনুসরণ করতে হবে এছাড়া কীটনাশক বিক্রির ক্ষেত্রে সনদ তদারকি বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন