অপূর্ব ভাস্কর্যের উদ্যান ভিজল্যান্ড পার্ক

মো. রাশেদুর রহমান রাশিব

নরওয়ে এমন একটা দেশ, যে দেশের নাম শুনলে ছোটবেলার একটা প্রশ্নের কথাই মনে পড়েযে দেশে ছয় মাস রাত আর ছয় মাস দিন তখন বারবার ভাবতাম কি অদ্ভুত কথা রে বাবা, কি এক আজব দেশ তার নাকি ছয় মাস দিন আবার ছয় মাস রাত। ভাগ্যের এমনই খেলা, সেই দেশের পাশের দেশে ফিনল্যান্ডে এসে পড়লাম পড়াশোনা করতে।

বেশ অনেকবার পরিকল্পনা করেও নরওয়ে যাওয়া হচ্ছিল না, অবশেষে বন্ধু নিষাদ আদনানের কল্যাণে সেই সুযোগটা চলে এল। নিষাদ এসেছিল সুইডেনের স্টকহোমে মাসব্যাপী এক কর্মশালায় অংশ নিতে। আমি এক বিশাল প্রমোদতরীতে বাল্টিক সাগর পার হয়ে প্রথমে এলাম স্টকহোমে, তারপর দুই বন্ধু মিলে চড়ে বসলাম দোতলা বাসে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাব কিন্তু নেই কোনো ইমিগ্রেশন, নেই কোনো ঝামেলা। সেনজেন চুক্তি নামের একটা অসম্ভব সুন্দর চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপের ২৭টি দেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণে কোনো বাধা পেরোতে হবে না। সভ্যতা এই মানুষদের সভ্য করে তুলেছে।

সুইডেন, ফিনল্যান্ড আর নরওয়ে পাশাপাশি তিন দেশ। ফিনল্যান্ডের উত্তরে তিন দেশের সীমানা একই সঙ্গে মিশেছে। গত বছর ফিনল্যান্ডের শত বছর পূর্তি উপলক্ষে নরওয়ে একটা পাহাড় উপহার দেয়। হালতি নামের সেই পাহাড় উপহার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক সীমানাও ২০০ মিটার পরিবর্তন করে। সে যা- হোক, সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে ঘণ্টার বাসজার্নির দূরত্ব নরওয়ের রাজধানী অসলো। রাতের বাসের জানালা দিয়ে দূরের খামার কিংবা মিটে মিটে আলো জ্বলে থাকা কোনো গ্রাম দেখা যায়। এখানকার গ্রামগুলো খুব সুন্দর, ছবির মতো সাজানো। খুব ভোরে আমরা অসলো শহরে এসে পৌঁছলাম। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। শহরে আমাদের পরিচিত কেউ নেই, তাই আমরা গুগল ম্যাপকে সঙ্গী করে প্রথমে অসলোর বিখ্যাত অপেরা হাউজ দেখতে  গেলাম। আকাশে মেঘ, টিপটিপ বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মাঝেও আমাদের মতো অনেক পাগলকে দেখলাম সেখানে। আমরাও কিছুক্ষণ ঘুরে চলে গেলাম ফ্রগনার পার্কের উদ্দেশে।

ফ্রগনার পার্ককে ভিজল্যান্ড পার্ক নামেই সবাই চেনে। অসলো শহরের প্রায় মাঝখানে এই ভিজল্যান্ড। পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত, নেই কোনো টিকিট। বৃষ্টিস্নাত সবুজ পার্কটিকে যেন এক সবুজ বন মনে হচ্ছিল। ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা ছোট লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে একটা সেতুর সামনে উপস্থিত হই। সেতুর দুই রেলিংয়ে অসাধারণ সব ভাস্কর্য। মোট ২১২টি ভাস্কর্যের স্রষ্টা গুস্টাভো ভিজল্যান্ড মূলত একজন ভাস্কর। ভাস্কর্যের পার্কটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাস্কর্যের পার্কও বলা হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে অসলো শহরের ফ্রগনার এলাকায় তিনি ভাস্কর্যগুলো তৈরি করেন। মূলত গ্রানাইট পাথরের ভাস্কর্যের সংখ্যাই বেশি, এছাড়া কিছু ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য রয়েছে। প্রতিটি ভাস্কর্যে মূলত মানব সমাজের সম্পর্ক উপজীব্য করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কখনো ছোট্ট শিশুর সঙ্গে বাবার কিংবা মায়ের খেলার চিত্র, কখনো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মান-অভিমান খুনসুটির চিত্র। মানব-মানবীর ভালোবাসা, সংঘাত, উচ্ছলতা জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে ভাস্কর্যগুলোয়। যতই দেখছিলাম, ততই অবাক হচ্ছিলাম। পার্কের ঠিক মাঝখানে এক বিশাল ফোয়ারা। তার পাশে বিশাল পাথরের মনোলিথ। বিশাল একটা পাথরে যখন ভাস্কর্য বানানো হয়, তখন সেটা মনোলিথ ভাস্কর্য। অবাক বিস্ময়ে হা হয়ে যাওয়ার দশা আমাদের দুজনের। কি অপূর্ব মানুষের কল্পনা, কি দারুণ কাজ। মনোলিথের মাঝের স্তম্ভটা অদ্ভুত সুন্দর। নিচ থেকে উপরের দিকে তারুণ্যের জয়গান।

আলো-ছায়ার খেলার মাঝেই আবার বৃষ্টি চলে এল। আমরা আশ্রয় নিলাম এক ছাউনিতে। সেখানে কথা হলো এক কানাডিয়ান পর্যটকের সঙ্গে, সে একাই ঘুরতে বেড়িয়েছে ইউরোপ। বয়সে আমাদের সমানই হবে। দেশ, জাতি, ভ্রমণ, পড়াশোনা, খেলাধুলা নিয়ে বেশ আড্ডা হলো। সময় আকাশে দেখা দিল রংধনু। ছাউনির সবাই বেশ উত্ফুল্ল। প্রকৃতির বিষয়গুলো আসলে সবাইকেই আনন্দ দেয়। সময় ঘুরে প্রায় বিকাল, দানাপানি কিছুই তেমন পড়েনি পেটে। যদিও মন বলছিল সন্ধ্যার আলোকসজ্জা দেখে যাওয়ার। নরওয়ে থেকে ফেরার পথে বারবার সেই ভাস্কর্যগুলোই চোখে ভেসে উঠছিল এক ঘোরলাগা বিস্ময়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন