উৎপাদন খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, বাণিজ্য বিরোধ না থাকা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষের ফলে ভিয়েতনামের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ চাঙ্গা। এ অবস্থায় চলতি বছর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীতের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রবৃদ্ধি অর্জনের এ হার ভিয়েতনামের ইতিহাসে দ্রুততম এবং কারখানাসমৃদ্ধ চীনের চেয়ে বেশি। খবর ভয়েস অব আমেরিকা।
ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় সরকার দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে ৬ দশমিক ৮ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীত করতে চাইছে। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ের নিরাপত্তা বিশ্লেষক সংস্থা এসএসআই রিসার্চ বিষয়টি নিশ্চিত করে ৩ জানুয়ারি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দেশটির প্রবৃদ্ধিতে প্রধান চালিকাশক্তি হবে ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খাত। পাশাপাশি অব্যাহত থাকবে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) উপাত্ত বলছে, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হলে ভিয়েতনাম এ বছর এশিয়ার দ্রুতবর্ধনশীল ১০টি অর্থনীতির তালিকায় স্থান করে নেবে। একই সঙ্গে এ তালিকায় দেশটি চীনের চেয়েও এগিয়ে থাকবে। এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ।
সিঙ্গাপুরের সিআইএমবি গ্রুপের ব্যাংকিং শাখার অর্থনীতিবিদ সেং উন বলেন, ভিয়েতনামের অর্থনীতির বড় অংশজুড়ে রয়েছে কারখানা, বিভিন্ন অফিস ও বন্দরে অব্যাহত অর্থ প্রবাহ। এ অবস্থায় দেশটিতে অভ্যন্তরীণ ভোগের বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
এছাড়া বিগত সাত বছরের মতো এবারো বৈদেশিক বিনিয়োগের উৎপাদন খাত ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে নেতৃত্ব দেবে। তাছাড়া ১৩২ ডলারের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ও সরকারের স্থিতিশীলতা দেশটিকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
ভিয়েতনামে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মূলত জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের। তারা দেশটির কারখানায় তৈরি পোশাক, গাড়ির যন্ত্রাংশের পাশাপাশি বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদন করে। পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ভিয়েতনামে বিভিন্ন উৎপাদন খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় ৯১০ কোটি ডলার, যা এর আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি।
এদিকে উৎপাদন খাত ছাড়াও পর্যটন ও উচ্চশিক্ষায় ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধির ভালো সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরা। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশটিতে পর্যটকের সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখে উন্নীত হয়েছে। বিশেষ করে দিন দিন বাড়ছে চীনা পর্যটকের সংখ্যা।
অন্যদিকে ২০০০ সালে ভিয়েতনামের ১০ শতাংশ মানুষ উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় তিন গুণ। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ সহযোগী মুরে হিবার্ট বলেন, ভিয়েতনামে দিন দিন উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। কারণ দেশটিতে বিনিয়োগকারীরা এমন শ্রমিক ও কর্মচারী চাইছেন, যারা সমস্যা সমাধানে অনেক বেশি দক্ষ। বিনিয়োগকারীরা প্রযুক্তিতে দক্ষ কর্মী তো চাচ্ছেনই, একই সঙ্গে চাচ্ছেন ভালো অফিস ব্যবস্থাপকও।
এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের ভালো পদক্ষেপ হলো তারা শিক্ষা খাতকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তবে সমস্যা হলো দেশটির কনফুসীয় শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষায় পাসের জন্য শিক্ষার্থীদের শুধু মুখস্থ বিদ্যা শেখাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবে সমস্যা সমাধান কিংবা জটিল চিন্তা করতে শিখছে না।
সার্বিকভাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত চীন-যুক্তরাষ্ট্র চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ভিয়েতনাম লাভবান হচ্ছে। পণ্য উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে বড় এ দুই দেশের বিরোধের ফলে ২০১৮ সালে বহু বিনিয়োগকারী তাদের অর্থ চীন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এর বদলে তারা বেছে নিয়েছেন ভিয়েতনামকে। আর চীনবিমুখ এ বিনিয়োগ ২০১৮ সালে ভিয়েতনামের জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ যোগ করেছে।
এদিকে ২০১৮ সালে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অথচ গত বছর দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়া হয় ৬ দশমিক ১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে এ বছরও চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পতন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।