বিআরটিসির বাসের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কাল

রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীনতা ও নিম্নমানের বাস কেনা বন্ধ করতে হবে

বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার যানবাহন যেখানে অবলীলাক্রমে ১০-১৫ বছর ধরে চলে, সেখানে বিআরটিসির বাসগুলো রাস্তায় নামার দু-তিন বছরের মধ্যেই জরাজীর্ণ, অকেজো অথবা অচল হয়ে পড়ে প্রধানত রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালনাগত ত্রুটির কারণে। অবহেলা ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাও বিআরটিসির বাস দ্রুত নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী বলে এরই মধ্যে চিহ্নিত। টিআইবি তাদের গবেষণায় বলেছে, সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি অর্থ আত্মসাতের কারণে বিআরটিসি লাভের মুখ দেখে না। সংস্থাটির ডিপোগুলোয় যানবাহন মেরামতের ব্যবস্থাসহ জনবলও রয়েছে। তার পরও দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা। মেরামতের কোনো চেষ্টা না করেই ফেলে রাখা হয় যানবাহনগুলো। নিম্নমানের গাড়ি কেনার অভিযোগও রয়েছে। দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে কেনা ওইসব বাস ঘোষিত লাইফটাইমের এক-তৃতীয়াংশ সময়ের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়েছে। মূলত অবহেলা আর কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই কোনো বাস অচল হয়ে ডিপোতে গেলে সেটি আর রাস্তায় ফিরে আসে না। ফলে সরকারি সংস্থাটির মোট বাসের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অচল হয়ে পড়েছে। গত দুই দশকে বিআরটিসিতে যেসব গণপরিবহন কেনা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ভলভো দ্বিতল বাসগুলো ছাড়া বাকি সবই নিম্নমানের। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ওসব বাস লক্কড়ঝক্কড় অবস্থায় ডিপোতে ঠাঁই নিয়েছে। আর ভলভো বাসগুলোও কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ না করে নির্ধারিত লাইফটাইমের আগেই বিকল করে ডিপোবন্দি করা হয়। সঠিকভাবে মেরামত করা হলে আরো ২৫-৩০ বছর ভলভো বাসগুলো সার্ভিস দিতে পারত। ভলভো বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। নষ্ট হওয়ার পর সেগুলোর যন্ত্রাংশ সময়মতো লাগানো হয়নি। ফলে ব্যবহারের আট বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত নষ্ট হয়ে যায় বাসগুলো।

পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্র প্রদেশ বা আগরতলার সরকারি বাসসেবা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক উন্নত। কয়েক হাজার বাসের সমন্বয়ে সাজানো তাদের বহর। তাদের সফলতার মূল বিষয় হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা সুশাসন। আমাদের এখানে যার বড়ই অভাব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও এখানে বাস্তবায়ন হয় না। প্রধানমন্ত্রী বিআরটিসিকে লাভজনক এবং এর সেবাকে আরো উন্নত করতে কয়েক দফায় নির্দেশনা দিয়েছেন, যার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ইজারা প্রথা বাতিলের নির্দেশনাও উপেক্ষিতই থেকে গেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ছাড়া বিআরটিসির বাসের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। শুধু নতুন পরিবহন কিনলেই হবে না, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ মেরামতে যথাযথ বরাদ্দও রাখতে হবে। সবচেয়ে আগে দরকার ইজারা প্রথা বাতিল করে বিআরটিসির নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে বাস পরিচালনা দেখভাল করা। কারণ ইজারাগ্রহীতা যেমন-তেমন করে বাস পরিচালনা করে নিজের মুনাফা সর্বোচ্চ করায় ব্যস্ত থাকে বেশি। সেখানে বাস নষ্ট হলেও তারা চিন্তা করে না। আবার বিআরটিসির মেরামত বাবদ বরাদ্দ কম থাকায় বা অনুমোদন হতে অধিক সময়ক্ষেপণের কারণে বাসের ক্ষত এত বড় হয়, যা আর মেরামতের যোগ্য থাকে না। অবস্থা থেকে বিআরটিসিকে বের করে আনতে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। কারণ এখান থেকে একটি শ্রেণী অসাধু প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, যা সরকারের লোকসানের পাল্লাই ভারী করছে।

বিআরটিসিকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন পড়েছে। এজন্য প্রথমেই যা করা দরকার তা হলো সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে সংস্থাটির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। ভেঙে ফেলতে হবে সিন্ডিকেট চক্র। দ্বিতীয়ত, সংস্থার বিভিন্ন স্থাপনা জরুরি ভিত্তিতে টেন্ডারের মাধ্যমে বাজারমূল্যে ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, আয় ব্যয়ের হিসাবের শুভংকরের ফাঁকি রোধ করে প্রকৃত আয় যাতে সংস্থার অনুকূলে থাকে, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। কেবল বাস কেনা বা রক্ষণাবেক্ষণ নয়, সব ক্ষেত্রেই বিআরটিসির ব্যর্থতা অপরিসীম। বেসরকারি পরিবহন সংস্থাগুলো যখন রমরমা ব্যবসা করছে, তখন বিআরটিসি লোকসানের অজুহাতে বিভিন্ন রুট বন্ধ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থের অভাবে অনেক নাগরিক সুবিধাই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অথচ অপরিণামদর্শিতা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নষ্ট হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। অবস্থার উত্তরণ ঘটানো খুব জরুরি। এজন্য সরকারি ক্রয়ে মান নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে; অদক্ষতা কাটিয়ে উঠতে হবে। ক্রয় প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি জনগণের অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন