১৪২ কোটি টাকা ঋণখেলাপি

ফেরার লতিফ সিদ্দিকীর পরিবার

হাছান আদনান

আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী হওয়ার পর ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিং লিমিটেড নামে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তার পরিবারের সদস্যরা। স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী, ছেলে অনিক সিদ্দিকী মেয়ে রাইনা ফারজিন বনে যান বড় ব্যবসায়ী। গড়ে তোলা হয় ধলেশ্বরী লিমিটেড নামে পৃথক একটি কোম্পানিও। দুই কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া হয় শতকোটি টাকার ঋণ। সে ঋণ আর পরিশোধ হয়নি। বর্তমানে তিন ব্যাংকের মামলার আসামি হয়ে ফেরার হয়েছেন লতিফ সিদ্দিকীর পরিবারের সদস্যরা।

খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেড। মামলাগুলোয় আসামি করা হয়েছে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী, ছেলে অনিক সিদ্দিকী মেয়ে রাইনা ফারজিনকে। পরিবারটির কাছে ব্যাংক তিনটির সব মিলিয়ে পাওনার পরিমাণ ১৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। যদিও বিভিন্ন ঠিকানায় অভিযান চালিয়েও আসামিদের খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।

তৃতীয় দফায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি মন্ত্রী হওয়ার দুই বছর পর ২০১১ সালে এবি ব্যাংকে ঋণের আবেদন করে ধলেশ্বরী লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রিন্টিং প্রেসের কাজ করা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হলেন লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী, যিনি নিজেও আগে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির এমডি দম্পতির ছেলে অনিক সিদ্দিকী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির নামে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে এবি ব্যাংক। সরকারি-বেসরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এর পর থেকে ধলেশ্বরী লিমিটেডের নামে ঋণের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কিন্তু সে অর্থ আর ব্যাংকে ফিরে আসেনি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির নামে সুদসহ এবি ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণ ১০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

ধলেশ্বরী লিমিটেডের নামে ৩১ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডেরও। শুধু প্রিন্টিং প্রেসের নামেই এবি ব্যাংক পদ্মা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ কোটি টাকা। ঋণের পুরোটাই ২০১৪ সাল থেকে খেলাপি। লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায়ে অনেক আগেই মামলা করেছে ব্যাংক দুটি।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বিপুল পরিমাণ ঋণ থাকলেও বর্তমানে ধলেশ্বরী লিমিটেডের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাজধানীর কাঁটাবনে একটি প্রিন্টিং প্রেস ছিল। কিন্তু পুলিশ প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় গিয়ে কোনো প্রিন্টিং প্রেসের সন্ধান পায়নি।

ধলেশ্বরী লিমিটেডের মতোই এবি ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নেয়া হয় লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের আরেক প্রতিষ্ঠান ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিং লিমিটেডের নামে। কোম্পানিরও চেয়ারম্যান লায়লা সিদ্দিকী এমডি অনিক সিদ্দিকী।

২০১২ সালের শুরুতে ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিং লিমিটেডের নামে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন দেয় এবি ব্যাংক। রাজধানীর কারওয়ান বাজার শাখা থেকে দেয়া ঋণের কোনো অর্থ আর ফেরত পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটির নামে আরো ঋণ দেয় এবি ব্যাংক। ২০১৯ সাল শেষে ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিংয়ের নামে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণ ২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া ঋণের পুরো অর্থ খেলাপি হলে ২০১৮ সালের জুনে পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ডাউনপেমেন্টের অর্থও এবি ব্যাংককে দিতে পারেননি তারা। ফলে উদ্যোগ নিয়েও ঋণটি পুনঃতফসিল করতে ব্যর্থ হয় লতিফ সিদ্দিকীর পরিবার।

বিষয়ে এবি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারিক আফজাল বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্বাস করেই সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী পরিবারকে ঋণ দেয়া হয়েছিল। যদিও সে বিশ্বাসের মর্যাদা তারা রাখেননি। ব্যাংকিং খাতের অন্য খেলাপিদের মতোই লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের সদস্যরা এবি ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ফৌজদারি অপরাধে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের গ্রেফতার করছে না।

এবি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর মতে, লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের সদস্যরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। কারণ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তারা কোনো অর্থ ফেরত দেননি। একবার পুনঃতফসিলের ডাউনপেমেন্ট চেক দিলেও সে অর্থ নগদায়ন হয়নি। আমরা মনে করছি, তারা ইচ্ছা করেই টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা না পেলে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমবে না।

ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিং লিমিটেডের নামে ৫৬ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকেরও। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় এটিও খেলাপি হয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে এরই মধ্যে মামলা করেছে জনতা ব্যাংক। বাধ্য হয়েই মামলা করা হয়েছে বলে জানান জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ। তিনি বলেন, রিয়েল এস্টেটের জন্য ভূমি উন্নয়নে ঋণটি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে ঋণ আর ফেরত আসেনি। টাঙ্গাইলে ম্যাজেস্টিকা ইন্ডাস ভ্যালীর পুরো জমি আমাদের কাছে জামানত আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর প্রভাব কাজে লাগিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংকগুলোর এসব ঋণ অনুমোদন হয়েছে ২০১১ সালের পরে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর তার সব ঋণই উঠে গেছে খেলাপির খাতায়। ব্যাংকঋণ ডাইভার্ট হওয়ার কারণেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যে দুই প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গেছে, তার একটির অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার বিষয়েও ব্যাংকগুলোর কাছে কোনো তথ্য নেই।

বিষয়ে ব্যাংকারদের বক্তব্য হলো, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী সন্তানরা ব্যবসায় নেমেছিলেন। অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীর প্রভাবের কারণে সে সময় ব্যাংকগুলো কোম্পানি দুটিকে ঋণ দিয়েছে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমও গুটিয়ে গেছে। তার পর থেকে সাবেক মন্ত্রীর পরিবার ব্যাংকের টাকা পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছে।

[সংসদ সদস্য থাকাকালে নিজ পরিবারের সদস্যদের ম্যাজিস্টিকা ইন্ডাস ভ্যালি বাণিজ্যিক প্রকল্প স্থাপনে সম্মতিপত্র দেন লতিফ সিদ্দিকী]

টাঙ্গাইল- আসনের এমপি থাকাকালে ২০১১ সালের জুন ম্যাজেস্টিকা ইন্ডাস ভ্যালী নামে একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প স্থাপনের সম্মতিপত্র দেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। স্থানীয় এমপি হিসেবে জাতীয় সংসদের প্যাডে দেয়া প্রত্যয়নপত্রে তিনি বলেন, উপযুক্ত বিষয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, ম্যাজেস্টিকা ইন্ডাস ভ্যালী, গ্রাম-কদিমহামজানী, ইউনিয়ন-দূর্গাপুর, উপজেলা-কালিহাতী, জেলা-টাঙ্গাইলে বাণিজ্যিক প্রকল্প স্থাপনে আমি অবগত আছি। উক্ত প্রকল্পটি আমার নির্বাচনী এলাকায় স্থাপিত হলে আমার কোন আপত্তি নেই।

নিজের স্ত্রী সন্তানদের নামে গড়ে ওঠা ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিং লিমিটেডের জন্য প্রত্যয়ন দেয়ার সময় আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন।

রাজধানীর গুলশান--এর ২৩/ রোডের নম্বর বাড়িটি আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। ছয় কাঠা জমির ওপর সাততলা বাড়িটির পুরোটাই ব্যবহার করছেন তার পরিবারের সদস্যরা। এবি ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার সময়ে বাড়িটি জামানত রাখা হয়। ব্যাংকটির করা মামলায় গতকাল লতিফ সিদ্দিকীর পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য বাড়িটিতে অভিযান চালিয়েছিল গুলশান থানা পুলিশ। যদিও ওই সময় বাড়িতে লতিফ সিদ্দিকী পরিবারের কেউ ছিলেন না।

প্রসঙ্গে গুলশান থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) কামরুজ্জামান বলেন, সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী দুই সন্তানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আদেশ আমরা পেয়েছি। কিন্তু তারা অনেক আগেই বিদেশে চলে গেছেন। গুলশানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তার ছেলে অনিক সিদ্দিকীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠালে সাড়া পাওয়া যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন