শেয়ারবাজারের হঠাৎ পতন

বিনিয়োগকারীদের আস্থা নিশ্চিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন

আস্থার সংকটের বৃত্ত থেকে দেশের শেয়ারবাজার বের হতে পারেনি এখনো, যার সূত্রপাত ২০১০ সালে। প্রণোদনা দেয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, তারল্য সংকটসহ নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক। টেলিকম, জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ভাবছেন সংকটের কারণে ভবিষ্যতে এসব খাতের শেয়ারের দর কমে যাবে। আর এসবের প্রভাব পড়েছে সংশ্লিষ্ট খাতের শেয়ারদরে। সঙ্গে যোগ হয়েছে মন্দ প্রাথমিক গণপ্রস্তাব, সুশাসনের অভাব স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতি আস্থাহীনতা। শেয়ারবাজারকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে হলে সবার আগে দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভিত শক্তিশালী করা। বাজারের ওপর আস্থা না থাকলে প্রণোদনা দিয়ে বাজারকে খুব বেশি দূর এগিয়ে নেয়া যাবে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট প্রকট। সংকট কাটানোর উদ্যোগ নেয়া না হলে শেয়ারবাজারের তারল্য পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে না বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল বিনিয়োগ আকর্ষণের কেন্দ্রে নিতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিনিয়োগে আনতে হলে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বড় ধরনের সংস্কার জরুরি।

দেশের আর্থিক খাতে তারল্য সংকটের পাশাপাশি সম্পদের মানে অবনমন হয়েছে, যা শেয়ারবাজারকেও প্রভাবিত করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি ডিএসইতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। গত কয়েক বছরে কিছু মন্দ আইপিওর অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং এসব কোম্পানির কিছু বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। সবকিছু মিলিয়েই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ে চরম আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। কারণে শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। দেশের শেয়ারবাজার অনেকটা অপুষ্ট শিশুর মতো বড় হচ্ছে। সুষ্ঠু বিনিয়োগ ধারা সৃষ্টি করতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সৃষ্টির জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত লেনদেন সূচক কতটা বাড়ল, সেদিকে নজর না দিয়ে বাজারের টেকসই উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী শ্রেণীর দিকে নজর দেয়া।

বিশ্বের সব শেয়ারবাজারই ভালো অবস্থায় রয়েছে। পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে শেয়ারের সূচক ১১ হাজার পয়েন্টের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ভারতের শেয়ারবাজারের সূচকও প্রতিদিন বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশেরটাই উল্টো পথে চলছে। যদিও গত বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, বিনিয়োগ করে কেউ ঠকবেন না। অবশ্যই লাভবান হবেন। এজন্য বিনিয়োগকারীদের পক্ষে কিছু বাস্তব সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু আস্থাহীনতায় অর্থমন্ত্রীর সেই আশ্বাসের কোনো কিছুই পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া কয়েক বছরে শেয়ারবাজার ইস্যুতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কয়েক দফা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। বর্তমান সাবেক অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছেন। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও বৈঠক করে সমস্যার কথা শুনেছেন। বাজারের জন্য সহায়ক হতে পারে এমন পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই আস্থার সংকট কাটছে না।

সরকারের এমন আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও শেয়ারবাজার সংকটের সমাধান হয়নি। এর অন্যতম কারণ অনেক পদক্ষেপই সময়মতো না নেয়া। আর কারণে নতুন করে কেউই বাজারে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। তাছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার একের পর এক মানহীন কোম্পানির নতুন আইপিওর অনুমোদন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে চরম সমন্ব্বয়হীনতার ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। সর্বাগ্রে সরকার নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে নিবিড় সমন্বয় দরকার। শুধু নিজেরা সমন্ব্বয়ের কথা বললে হবে না। বিনিয়োগকারীরা যাতে বুঝতে পারেন সরকারের সব সংস্থা শেয়ারবাজারের উন্নয়নে আন্তরিক, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যখনই দরপতন মাত্রা ছাড়িয়েছে, সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তখনই সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে উঠেছেন। দফায় দফায় সভা করেছেন। বেশির ভাগ সময় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার বাস্তব কার্যকারিতা ছিল না বা বিলম্বে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কার্যকর হয়েছে আরো পরে। তার চেয়েও বড় কথা, শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান অগ্রগতিই হয়নি। এমন অবস্থা বিরাজ করলে দেশের শেয়ারবাজার কখনই ঘুরে দাঁড়াবে না।

ব্যাংক সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাব জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। প্রভাবশালীদের চাপে আইপিওতে (প্রাথমিক শেয়ার) নামসর্বস্ব দুর্বল কোম্পানি আসা, বেপরোয়া প্লেসমেন্ট (বাজারে আসার আগেই শেয়ার বিক্রি) বাণিজ্য, বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা, তারল্য সংকট, তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ কোম্পানির আয় কমে যাওয়া, সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণও ওপেন সিক্রেট। শেয়ারবাজারে ফটকাবাজারির অভিযোগের তদন্ত হয়েছে এর আগে। কিন্তু এজন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিণতির দায় অনেকাংশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেরও (বিএসইসি) কেননা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা করাই তাদের দায়িত্ব। তারা সেটি পালনে সফল হয়নি। সবারই জানা, বাংলাদেশে শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা হলো বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। কারণ বিভিন্ন সময়ে যারা বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তাদের বিচার হয়নি। ফলে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে হবে; সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন