আলোকপাত

সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কাঠামো ও পদ্ধতিগত দুর্বলতা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সামগ্রিকতায় একটি অর্থনীতি সবার, সব শরিকের। সরকারের, বিরোধী দলের, আমদানি-রফতানিকারকের, উৎপাদকের, ভোক্তার, মিডিয়ার, আমজনতার।  পরিভাষায় এটিকে সামষ্টিক অর্থনীতি (ম্যাক্রো ইকোনমি) বলা হয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাহিদা সরবরাহের, আয়-ব্যয়ের পারস্পরিক প্রভাবক ভূমিকার জন্য এর যথাযথ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকলে অর্থনীতি সুস্থ-সাবলীলতায় জোরালোভাবে গ্রো করে বা এগিয়ে যায়। জিডিপির  প্রবৃদ্ধি বলতে একটি সামগ্রিক সাফল্যের সূচকই বোঝায়। সাফল্যের সূচক সামগ্রিকতার না হলে সেটিকে জিডিপির প্রকৃত প্রবৃদ্ধি বলা যাবে না। অর্থ ব্যয় বা বিনিয়োগের দ্বারা যে পণ্য বা সেবা উৎপাদিত হয়, তার প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক যোগ্যতা উত্কর্ষের পরিমাপক হলো জিডিপি। ধরা যাক, কোটি টাকায় একটি সেতু নির্মাণে খরচ ১৫ কোটি টাকা দেখানো হলে অর্থাৎ কোটি টাকার সেতুকে কোটি টাকা দাম ধরে জিডিপি হিসাব করা হলে অথবা ওই ১৫ কোটি টাকায় তিন সেতুর প্রত্যাশিত উপযোগিতা মাত্র একটি সেতুতে পাওয়া গেলে উন্নয়নের বা বিনিয়োগে বল ব্যাটের সমন্বয় তো হবেই না, রানও উঠবে না। হিসাব অনুযায়ী তিনটি সেতু পাওয়ার কথা, পাওয়া যাচ্ছে মাত্র একটি। এজন্য অনেকেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অনেকেই বলছেন, একদিকে জিডিপিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দুই ডিজিটে হওয়ার সম্ভাবনা মাঠে মারা যাচ্ছে। আবার এটাও ভাবা হয়, পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের জিডিপি খুব বড় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে বড় নয়। দেশজ সম্পদের সঠিক হিসাবায়নে, হিসাবের আওতা বোধগম্যকরণে সীমিত কিংবা প্রসারিতকরণের ফলে গরমিল থাকায় বা ঘটায় প্রবৃদ্ধি প্রায় ক্ষেত্রে ফাঁপা কিংবা ফোপরদালালির কিংবা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।

শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্য দেশেও এমনটা দেখা গেছে। ১৯৯৭ সালে যেএশীয় আর্থিক সংকটদেখা দিয়েছিল, তার এপিসেন্টার ছিল থাইল্যান্ড জাপানে; সেটিও প্রায় এমনটাই ছিল। সে সময় সবার ধারণা জন্মাল যে আবাসন খাত খুব লাভজনক। ফলে খাতে ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণ ঋণ দিল। ভেবেছিল ঋণের অর্থ উঠে আসবে। দেখা গেল, যে দালানে খরচ হতে পারত ২৫ টাকা, সেখানে লগ্নি করা হলো ৭৫ টাকা এবং সেটি করা হলো খুব ব্যয়বহুল দেখিয়ে বা অপচয় করে। ফলে ৭৫ টাকার দালান নির্মাণ করার পর লক্ষ করা গেল যে কেউ আর কিনছে না বা কিনতে চাইছে না। কারণ অর্থনীতিতে সেই সক্ষমতা নেই। কাজেই দালানগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রিটার্ন আসা তো দূরের কথা, কেউ কিনছে না। এর পেছনে মূল্যস্ফীতিমূলক খরচ যে হয়েছে, তা থেকে রিটার্ন আসা তো দূরের কথা, সেটি অবচয়মূলক খরচে পরিণত হলো। ফলে যেসব ব্যাংক অর্থায়ন করেছিল, তাদের পুঁজির সংকট সৃষ্টি হলো। কারণ তাদের ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না বা রিটার্ন পাচ্ছে না। একটি পর্যায়ে এসব দেশের গোটা অর্থনীতি আস্থাহীনতার খাদে পড়ে গেল।৯৭-এর এশীয় আর্থিক সংকটের মোদ্দাকথা ছিলরিটার্নের সুযোগ বা সক্ষমতা যথা পর্যবেক্ষণে না রাখায়, অবকাঠামো নির্মাণে সুশাসন বজায় না থাকায় অতিরিক্ত অর্থ অপব্যয়ে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়। ব্যাংক দেউলিয়া হওয়া পুরো অর্থনীতিতেই ধস নামার নামান্তর। কারণ আর্থিক বাজারের প্রতি মানুষের আস্থা উঠে যাওয়ায় আমানতকারী নতুন আমানতে আসছেন তো নাই, বরং তারা আগের আমানত ফেরত চাইছেন। আর ব্যাংক টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কেননা লগ্নিকৃত অর্থের রিটার্ন আসেনি। তখন জাপান ৬২৩ ট্রিলিয়ন ইয়েন ব্যাংক খাতে সরকারি কোষাগার থেকে দিতে বাধ্য হলো। কারণ ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হবে। মানুষের আমানত  নিয়েই ব্যাংক ব্যবসা চলে। অর্থ না দিলে সব মানুষের বিনিয়োগ, আমানত প্রশ্নের মুখে পড়বে, যার জন্য জাপান রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলো উদ্ধার করে সে যাত্রায় রেহাই পেয়েছিল বটে কিন্তু তার ধকল সইতে হচ্ছে এখনো। 

আমাদের মতো উদীয়মান একটি অর্থনীতিতে যেখানে আমজনতার রেজিলিয়েন্স পাওয়ার খুব বেশি এবং সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষকের অবদানে যে দেশের অর্থনীতি ভালোভাবে গড়ে উঠছে, সে দেশে কিছুদিন পরপর ব্যাংক থেকে অর্থ চলে যাচ্ছে, উন্নয়নের জন্য ব্যয়িত অর্থ বেহাত হচ্ছে, অর্জিতব্য রাজস্ব আয় পাচার হয়ে যাচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণে নিয়োজিত একক ঠিকাদারের কাছে বিপুল নগদ অলস অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। নগদ অর্থ পাওয়া যাওয়ার মানে কী? এর মানে হলো টাকার কাজ ১০ টাকায় বাগিয়ে নিয়ে, টাকার কাজে টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। কাজে ফাঁকি দিয়েছে। অথবা ব্যয় বেশি (ইনফ্লেটেড) দেখিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন  করা হয়েছে। কাজের গুণগত মান এতটাই খারাপ যে রাস্তা বানানো শেষ হওয়ার আগে মেরামতযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে টাকার উৎপাদন বা পণ্য জিডিপিতে ১৫ টাকা দেখানো হচ্ছে। এই ১৫ টাকা থেকে বা ১০ টাকা কেউ না কেউ আত্মসাৎ করেছে। সেটিই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ক্যাসিনো কাণ্ড বা ঠিকাদারের বাড়িতে বিপুল অর্থ পাওয়ার ঘটনায় ধরা পড়ছে বা বেরিয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ সরকারি বৃহৎ অবকাঠামোর কাজ গুটিকয়েক ঠিকাদার পেয়েছেন।

প্রতীয়মান হয়, সমাজে-দেশে-অর্থনীতিতে যেন একটি নেতিবাচক সংস্কৃতি বিরাজমান। কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে পরস্পরের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চলে। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য জাপানের দৃষ্টান্ত খুবই অনুসরণীয়। জাপান যখন আর্থিক সংকটে পড়েছিল বা পড়ে, তারা কেউ কারো দোষ ধরতে যায় না, আকার-ইঙ্গিতেও মন্তব্য নয়। কার আমলে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং কারা এটি করেছে, সেটিও নয়। বরং তারা বলে, এটি অর্থনীতির সমস্যা। বর্তমানে যারা আছে বা যাদের সামনে সমস্যা হাজির, সবাইকে নিয়ে তাদের নিজেদেরই এটি সমাধান করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে আবাসন ঋণনীতির ভুল প্রয়োগ হয়েছিল। ফলে সংকটে পড়েছিল ব্যাংকিং খাত। এজন্য নীতিনির্ধারকরা আলোচ্য খাতে ৬২৩ ট্রিলিয়ন ইয়েনের পুঁজি পুনর্ভরণ করেছিলেন, যাতে দেশের অর্থনীতি সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এগিয়ে যায়। ইতিবাচক প্রবণতা শুধু জাপান নয়, চীন, কোরিয়াসহ বেশকিছু দেশে দেখা গেছে। সেখানে কেউ কারো দোষ ধরে না বা দায় চাপায় না কিংবা অন্যরা অধম ছিল বলে নিজেরাও অধম হতে চায় না। ভাবখানা রকম—‘রাস্তায় পানি ফেললে কেন?’ এর জবাবে বলা হয়, ‘কেন, এর আগে তারাও তো ফেলেছিল।নিজের দোষ বা ভুল স্বীকারের পরিবর্তে অতীতের কিংবা অন্যের দোষ ধরার দ্বারা নিজের সাফাই গাওয়ার কিংবা বাহাদুরি দেখানোর জন্যই যেন সবাই সবার দোষ ধরে। পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতিতে অনিয়মকারী প্রশ্রয় পায়। আরেকজনের ওপর দোষ চাপালে প্রকৃত দোষী বা দোষ কিংবা এক্ষেত্রে কী করণীয়, সবই হালকা হয়ে যায়। প্রতিটি সমস্যার কারণ প্রভাব দেখা উচিত। কীভাবে কেন কারণটা তৈরি হয়েছে, তার দিকে না তাকিয়ে শুধু প্রভাব নিয়ে হা-হুতাশ করলে পারস্পরিক দোষারোপের ফলে সমস্যা সমাধানে মনোযোগ ফিকে হয়ে যায়। প্রতিকারের এমন ব্যবস্থায় যেতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে অনুরূপ অনিয়ম আর না হয়। অর্থাৎ অনিয়ম থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আরেকটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে, সংকট বা সমস্যাটি কেন হলো, সেটি খুঁজে বের করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া। এদিক-ওদিক করে দৃষ্টান্তমূলক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। আস্থার পরিবেশ তৈরি ব্যতিরেকে অনাস্থার মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না।

দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে আরেকটি লক্ষণ সুস্পষ্ট, যেকোনো আর্থসামাজিক সংকট বা জাতীয় সমস্যাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গণ্ডিবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এর বড় উদাহরণ রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ইস্যু হলো রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে এর প্রভাব সুন্দরবনে কেমন পড়বে। যারা ইস্যুতে আন্দোলন করছেন, তারা কী বলছেন, সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে, দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবনের স্বার্থে নিজস্বভাবে সেটি পরীক্ষা করে বিষয়টি সম্পর্কে যুক্তিসহ সংশ্লিষ্টদের অবস্থান স্পষ্ট করার অবকাশ অনস্বীকার্য। বিষয়ে যদি বিরোধী কোনো পক্ষ বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বিবৃতি দেয়, তখনই ইস্যুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্যদিকে। ইঙ্গিত করা হয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বা বিদ্যুৎ উন্নয়নে বাধা দেয়া হচ্ছে। জাতীয় সমস্যার ইস্যু চলে যায় দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা রাজনীতির কব্জায়। রকম বিভিন্ন ইস্যুতে পারস্পরিক দোষারোপের কারণে অর্থনীতির ক্ষতির পাল্লাই শুধু ভারী হয়।

একটি অর্থনীতিতে অসমতা বা ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বেকায়দায় পড়ে প্রান্তিক মানুষ, মধ্যবিত্ত। কতিপয় দুর্বৃত্ত উচ্চবিত্তকে ধরতে গিয়ে কঠোর যে আইনই করা হোক না কেন, তার প্রভাব গিয়ে পড়ে নিম্নবিত্তের ঘাড়ে। সুতরাং অবৈধ আয়ের উৎস আগে বন্ধ হওয়া দরকার। অনেক বছর ধরে ক্যাসিনো চলছে। এটা কি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের মোটেই জানা ছিল না? এক্ষেত্রে যিনি যে দায়িত্বে থাকেন, তাকে তা পালন করার বা পালন করতে দেয়ার প্রসঙ্গ চলে আসবে। দায়িত্ব পালনের পরিবেশ সুনিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাহলেই উৎসগুলো বন্ধ হবে। যদি সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার সিস্টেম বলবৎ থাকে এবং ব্যাংকগুলো যদি তাদের কেওয়াইসি পালন করে, তাহলে একজনের নামে ১০৯ কোটি টাকার এফডিআর রাখা যায় কীভাবে!

মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ বা ব্যবসার লাইসেন্স প্রদানকালে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কঠোর আইন করা হয়েছে। কিন্তু সেটি সুচারুভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না, যা হচ্ছে সেটিও পক্ষপাতদুষ্ট। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ আমজনতার বেলায় নিবর্তনমূলক কঠোর আইন প্রয়োগ হচ্ছে। তারা সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কিছু লোক অতিরিক্ত পেয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকারের ওই পদ্ধতি তো  বলবৎ আছে, যাতে কারো কাছে কীভাবে জমছে টাকা, উৎস কী, করছে কী, সেগুলো খতিয়ে দেখা হয়। সেটি করা হয়নি বা হয় না বলে এমনটি হচ্ছে। যেমন একজন ঠিকাদারের হাতে এত নগদ  টাকা এফডিআর জমে কী করে? দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ অর্থ উপার্জনের ফলে সমাজে অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে। এটা রোধ করতে হলে দুর্নীতির উৎসে দুর্নীতিবাজদের ঠেকাতে হবে। দুর্নীতি সংঘটনের পর দুর্নীতি দমন করা হবে, প্রতিরোধমূলক কোনো পন্থা নয়। দুর্নীতি কোথায় হচ্ছে, কেন হচ্ছে এবং কারা করছে, তা খুঁজে বের করার পথে ওঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে।

 

. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: উন্নয়ন অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন