সিলেটে তিন বছরে ৭৪ পাথর শ্রমিকের মৃত্যু

সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার ব্যতীত পাথর উত্তোলন বন্ধ করুন

সিলেটের কোয়ারিগুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়ার খবর নতুন নয়, সেখানে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকালে টিলা ধসে কিংবা গর্তের পাড়ের মাটি পাথরচাপায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেটে গত তিন বছরে ৭৪ পাথর শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বেআইনিভাবে পাথর উত্তোলনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই এসব বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটছেএমন অভিযোগ নানা মহলের। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে বেআইনিভাবে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। টাস্কফোর্সের অভিযানে ধ্বংস করা হয় অসংখ্য বোমা মেশিন। অবস্থায় পাথরখেকো চক্র দিনের বেলা নীরব থাকলেও রাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সন্দেহ নেই, যদি সঠিকভাবে এসব ব্যাপারে নজরদারি করা যেত, তবে এমন দুর্ঘটনা ঘটত না। যারা পাথর কোয়ারিতে শ্রমিকের কাজ করেন, তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাই বলে তাদের এভাবে করুণ মৃত্যু হোক, সেটা কোনো বিবেকবান মানুষ চান না। মানুষ অভাবের যন্ত্রণায় পাথর শ্রমিকের কাজ করতে যান। কীভাবে পাথর উত্তোলন করতে হয়, কীভাবে চোরাবালি তৈরি হয়, বিপদের সময় কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়, এসব বিষয়ে শ্রমিকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিলে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। শুধু তা- নয়, কোনো ধরনের সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার না করায় শ্বাসকষ্টসহ দীর্ঘমেয়াদি নানা স্বাস্থ্য সমস্যায়ও ভুগছেন পাথর শ্রমিকরা। এক্ষেত্রে দ্রুত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হোক। যেসব মালিক এসব মানবেন না, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

দেশের কোনো খনিতে কাজ করতে হলে প্রয়োজন হয় দক্ষ শ্রমিকের। তাদের দেয়া হয় প্রশিক্ষণ, তবেই তারা কাজ করার অনুমতি পান। কিন্তু এখানে হচ্ছে সব উল্টো। জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরফিন টিলাসহ আরো অনেক স্থানে গেলে দেখা যায় পাথর ভাঙার শত শত ক্রাশার মেশিনে বিকট শব্দে পাথর ভাঙা হচ্ছে, বাতাসে মিশে সেইসব ধূলিকণা আশপাশের মানুষের চরম ক্ষতি করছে। সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যখন পত্রপত্রিকায় খবর ছবি ছাপা হয়, টেলিভিশনে সচিত্র প্রতিবেদন দেখানো হয়, তখন প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিবেশ অধিদপ্তরের টাস্কফোর্স একটু জেগে ওঠে এবং অভিযান চালিয়ে বোমা মেশিন জব্দ করে নিয়ে আসে। কয়েক দিন পরই দেখা যায় আবারো বোমা মেশিনে পাথর ভাঙা হচ্ছে। আইনকানুন না মেনে ইচ্ছেমতো পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিদিন কত ঘনফুট গর্ত করে পাথর তুলতে পারবে, তার জন্য আইনের ধারা আছে। কিন্তু দেখা যায়, এসব পাথরখেকো মানুষরূপী দানব টাকার দাপটে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অমানবিক লোভের কারণে গরিব শ্রমিকদের করুণ মৃত্যু ঘটছে।

যখন কোনো পাথর কোয়ারি থেকে পাথর তোলা হয়, তখন উপরের অংশ নরম হয়ে যায়। আর হতভাগ্য প্রশিক্ষণহীন শ্রমিকরা না বুঝে কাজ করতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। পাথরখেকো ব্যবসায়ীদের কারণে কতশত তাজা প্রাণ এভাবে ঝরে যায়। সেই সঙ্গে পরিবার হারায় তাদের প্রিয়জনকে। দুর্ঘটনা ঘটার পর মালিকপক্ষ থেকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। অনেক সময় মরদেহ সরিয়ে ফেলা হয়। তাই এখন থেকেই জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের টাস্কফোর্স, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা পরিবেশের কথা চিন্তা করে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকারের আইনের ধারা অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। সেই সঙ্গে এসব পাথর ব্যবসায়ীর লাইসেন্স আছে কিনা, প্রতিদিন কত ফুট পাথর তুলবে, শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ আছে কিনাএসব ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। কোনো শ্রমিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আইনকে কাজে লাগিয়ে রক্ষা করতে হবে ১৬ কোটি মানুষের এসব প্রাকৃতিক সম্পদ। রক্ষা করতে হবে পরিবেশ, রক্ষা করতে হবে শ্রমিকদের, যাতে কোনো শ্রমিকের আর অকালমৃত্যু না হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর জাফলং, বিছনাকান্দি, কোম্পানীগঞ্জসহ অন্য সব পাথর কোয়ারি এলাকায় ১৫-৬০ ফুট বর্গমিটার পাথর উত্তোলনসহ পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। অতএব, যারা আইন অমান্য করে পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। শ্রমিকদের যথাযথ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের তদারকি জোরদার করার পাশাপাশি মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। অবৈধ পরিবেশবিধ্বংসী হয়ে থাকলে পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয়তা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কেউ অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন