চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপ-নির্বাচন

নৌকার প্রার্থী মোছলেম বিজয়ী

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনের উপ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। নৌকা প্রতীক নিয়ে মোছলেম উদ্দিন ভোট পেয়েছেন ৮৭ হাজার ২৪৬টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপি প্রার্থী আবু সুফিয়ানের ধানের শীষ পেয়েছে ১৭ হাজার ৯৩৫টি।

বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা মইন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এ আসনে সোমবার সকাল থেকে ১৭০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বোয়ালখালী উপজেলা এবং নগরীর চান্দগাঁও ও বায়েজিদের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসনটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৮ জন। এর মধ্যে বোয়ালখালী উপজেলায় ভোটার রয়েছেন ১ লাখ ৬৪ হাজার। আর শহরে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৮৮। ভোটকক্ষ মোট ১ হাজার ২৫২টি।

ভোটগ্রহণ শেষে গতকাল রাতে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়ামে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান। তিনি জানান, উপ-নির্বাচনে মোট বৈধ ভোট গণনা করা হয়েছে এক লাখ ৮ হাজার ৫৮১টি। যা মোট ভোটের ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

অন্য চার প্রার্থীর মধ্যে বিএনএফের এস এম আবুল কালাম আজাদ টেলিভিশন প্রতীকে পেয়েছেন ১১৮৫ ভোট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সৈয়দ মোহাম্মদ ফরিদ আহমদ চেয়ার প্রতীকে ৯৯২ ভোট, ন্যাপের বাপন দাশগুপ্ত কুঁড়েঘর প্রতীকে ৬৫৬ ভোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ এমদাদুল হক আপেল প্রতীকে পেয়েছেন ৫৬৭ ভোট।

এদিকে ভোটের মাঠে সর্বশক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলেও নিষ্ক্রীয় দেখা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমেদের অনুসারীদের সরব উপস্থিতি। এর বিপরীতে মাঠে দাঁড়াতেই পারেননি বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ানের অনুসারীরা।

গতকাল সোমবার ভোটগ্রহণের সময় চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে মোছলেমের অনুসারীদের একচেটিয়া বিচরণ। সংসদীয় এলাকার নেতাকর্মী তো ছিলই, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও আসা নেতাকর্মীদের মোছলেমের পক্ষে সরব  দেখা গেছে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের সামনে।

নগরীর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে সকাল থেকে নৌকার সমর্থকদের পাশাপাশি ধানের শীষের সমর্থকদেরও সরব উপস্থিতি ছিল। কিন্তু বোয়ালখালী উপজেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ধানের শীষের সমর্থকদের কেন্দ্রে পাওয়া যায়নি। দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সরব উপস্থিতি থাকায় নগরীর কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটের সময় উত্তাপও ছড়িয়েছিল। আর উপজেলায় বিএনপির  নেতাকর্মীদের অভাবে ভোটের চিত্রও দেখা গেছে অনেকটা একতরফা। তবে বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান এবং তার অনুসারীদের অভিযোগ- সকাল থেকে নৌকার সমর্থকরা অনেক  কেন্দ্রে এজেন্টদের মেরে বের করে দিয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে ও হুমকি দিয়ে ধানের শীষের সমর্থকদের কেন্দ্রে আসতে দেওয়া হয়নি।

সকাল ৯টা ২০ মিনিটে নগরীর বাকলিয়া নূরনগর এলাকায় মজিদিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, শান্তিপূর্ণভাবে ভোটারেরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এক মাদ্রাসায় দুই কেন্দ্রে মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ২৩৪৮ জন এবং মহলিা ২৫৫৪ জন। 

পুরুষ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার  মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘খুব সুন্দরভাবে ইভিএম এ  ভোট হচ্ছে। কারও কোনো অভিযোগ নেই।’

কেন্দ্রের বাইরে নৌকা প্রতীকের লেমিনেটিং করা কার্ড গলায় ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১০-১৫ জন তরুণ-যুবক। কয়েকজন ভেতরে ঢুকতে চাইলে পুলিশ ওই কেন্দ্রের ভোটার নন দেখে বাধা দেয়। কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন যুবলীগ নেতা মাসুদ করিম টিটু। তাকে নৌকার কর্মীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে দেখা গেছে।

এ কেন্দ্র থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরে রাবেয়া-বশর ইনস্টিটিউটের সামনে গিয়ে  দেখা যায়, নৌকা এবং ধানের শীষের সমর্থকদের পৃথক জটলা। দুপক্ষ কেন্দ্রের দুইদিকে অবস্থান নিয়েছে। ধানের শীষের এজেন্ট পরিচয়ে সালাহউদ্দিন শাহেদ নামে এক যুবক অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মারধর করে তাদের এজেন্ট বের করে দিয়েছে। ভোটগ্রহণ শুরুর আগে সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলেও জানালেন এলাকার কয়েকজন।

একই এলাকার মধ্যে চান্দগাঁও এনএমসি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে,  নৌকা ও ধানের শীষের সমর্থক এবং পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার দৃশ্য। এই  কেন্দ্রে সরব দেখা যায়, উভয় প্রার্থীর অনুসারীদের, যাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। 

কালুরঘাট সেতু পার হয়ে বোয়ালখালী পৌরসভা এলাকায় গোমদন্ডী সরকারী আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের সামনে সড়কে দেখা গেছে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর জটলা। বোয়ালখালীর পাশের উপজেলা পটিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম শামসুজ্জামানকেও দেখা গেছে সেই জটলায়। চোখে পড়েনি ধানের শীষের পক্ষের কাউকে। ভোট দিয়ে বের হওয়ার সময় রুমা আক্তার নামে এক নারী বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো ভোট দিয়েছি। কেউ কোনো সমস্যা করেনি।’

আমুচিয়া ইউনিয়নের পূর্ণ চন্দ্র সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের মাঠসহ আশপাশে কমপক্ষে ২০০ তরুণ-যুবক গলায় নৌকার কার্ড লাগিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। এলাকাটি বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেখানেও দেখা যায়নি ধানের শীষের পক্ষে তেমন কাউকে। কথা হয় ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফুদ্দিন নামে ধানের শীষের এক সমর্থকের সঙ্গে।


সারোয়াতলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে সুষ্ঠু ভোট। কিন্তু আসলে আমাদের দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি। সকাল থেকেই আওয়ামী লীগের লোকজন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের নেতাকর্মীরা সেখানে যেতেই পারছে না।’

নগরীতে শুরুতে আবু সুফিয়ান যেমন কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়েছেন, সঙ্গে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল। কিন্তু দুপুরে প্রথম দফায় সাংবাদিকদের কাছে এসে আবু সুফিয়ান পুনঃনির্বাচনের দাবি তোলার পর পরাজয় নিশ্চিতের আশঙ্কায় ভোটকেন্দ্র ছেড়ে যান তার নেতাকর্মীরা, এমনটাই বলছেন বিভিন্ন এলাকার সাধারণ ভোটারেরা। আর বোয়ালখালী উপজেলায় আবু সুফিয়ান নিজেও ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যাননি, নেতাকর্মীরাও ছিলেন না।

আবু সুফিয়ান বলেন, ‘চট্টগ্রাম-৮ আসনের অধিকাংশ কেন্দ্রে বহিরাগত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে কেন্দ্র দখলে নিয়েছে, বিএনপির এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। গোপন বুথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা জোরপূর্বক ভোট দিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছি ভোট স্থগিত করে, পুনারয় নির্বাচন দিতে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-৮ আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘উনারা সকালে কয়েকটি কেন্দ্রের বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন সেগুলোর জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। যখন যেখানে তারা বলেছেন সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট ও বিজিবি পাঠিয়েছি। অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্ট বের করে দেয়ার বিষয়টি উনারা যেভাবে বলছেন সেভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে জেতার জন্য আসেনি। তারা এসেছে আন্দোলনের ইস্যু খুঁজতে। একের পর এক অভিযোগ তুলেছে, যেগুলো অসত্য। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন