সাত সতেরো

নাগরিক কল্যাণে বিনিয়োগ ভাবনা: প্রেক্ষিত সিলেট

মো. আব্দুল হামিদ

সিলেটে একটি স্বনামধন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সম্প্রতি ঠিক তার পার্শ্ববর্তী জেলা সুনামগঞ্জে একই জাতীয় আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কিছুদিন আগে হবিগঞ্জ জেলায় আরেকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়ার খবরও বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষ ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মন্তব্য করছে। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করছে। যেমন একজন বললেন: উত্তরবঙ্গ (রাজশাহী রংপুর বিভাগ) বাংলাদেশের খাদ্যশস্যের সরবরাহকারী প্রধান অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও সেখানে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন হবিগঞ্জে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া খুব কি জরুরি ছিল? সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই কেন আবার একই বৈশিষ্ট্যের আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে? এমন সব মন্তব্য শুনেই প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে নিবন্ধটি লেখার ভাবনা মাথায় আসে।

সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশে খুব কম প্রজেক্টই শুধু প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে শুরু হয়। কাজ বের করে আনার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিরলসভাবে দীর্ঘদিন লেগে থাকেন বলেই একসময় বড় ওই প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখে। যতটা নাপ্রয়োজন’, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার হয় ধারণাটি (প্রকল্প) বের করে আনার মতো লোক এবং চেষ্টা। সেই আঙ্গিক থেকে উদ্যোগগুলো মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া সব সরকারের আমলেই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল থেকে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রতিনিধিত্ব করেন, যারা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে অনেক বড় প্রকল্প ছাড় করানোও মোটেই কঠিন ব্যাপার হয় না। তার পথ ধরেই প্রকল্পগুলো অনুমোদন হয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি।

তিন দশক আগে মূলত বিজ্ঞান প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান বিস্তারের লক্ষ্যে পথচলা শুরু করলেও আওতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে। কারণ বর্তমানে সামাজিক বিজ্ঞান, বাণিজ্য মানবিক বিষয়ক ডিপার্টমেন্টের সংখ্যা মোটেই কম নয়। তাছাড়া গত দশকে প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেবিজ্ঞান প্রযুক্তিশব্দবন্ধ যুক্ত করা অনেকটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ফলে কোনটি সাধারণ আর কোনটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, পার্থক্য করা বেশ মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমার ধারণা, অল্প সময়ের মধ্যেই সিলেটে প্রযুক্তি প্রকৌশল বিষয়ে পড়ানোর জন্য আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা শুনতে পাব। কারণ রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অনেক জায়গাতেই সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রযুক্তি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট, ডুয়েট, চুয়েট) রয়েছে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তি প্রকৌশল বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সিলেটে প্রযুক্তি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হতেই পারে।

একসময় আমাদের দেশে ডায়রিয়া পেটের অন্যান্য পীড়া ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। তার মোকাবেলায় আইসিডিডিআর,বির মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তারা বাংলাদেশে ওই সমস্যার সমাধান করার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য কিছু রিসার্চ আউটকাম উপহার দিয়েছে, যা মানবকল্যাণে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হচ্ছে। আবার ফিলিপাইনের ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আদলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে বিরি। প্রতিষ্ঠানটিও কৃষি গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। উদাহরণগুলো সামনে রেখে আমার মনে হয় সিলেট অঞ্চলে বেশ কয়েকটি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তারা বিষয়গুলো ভেবে দেখতে পারেন।

প্রতি বছর দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ অসংক্রামক (ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হূদরোগ ইত্যাদি) রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সেগুলোর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সিলেটের অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্য থাকায় তারা ওইসব রোগের চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছুটছে। লক্ষ্যে ভারত, থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুর যাওয়ার প্রবণতা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। গত কয়েক বছরে ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য সময়, অর্থ অন্যান্য জটিলতা বিভিন্ন পরিবারকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই সিলেটে একটি বিশ্বমানের ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল করা গেলে খুব ভালো হয়। বিশ্বায়নের যুগে খ্যাতিমান ডাক্তাররা এখানে এসে গবেষণায় সহযোগিতা চিকিৎসা করলে সিলেটসহ সারা দেশের মানুষ বিশেষভাবে উপকৃত হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, জীবনের খুব খারাপ সময়ে আক্রান্তরা প্রিয়জনদের কাছে পাবেন। সে সময় তাদের সান্নিধ্য খুব দরকার। তাছাড়া দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে যাওয়ার হাত থেকেও রক্ষা পাবে।  

সিলেট শহরের খুব কাছাকাছি রয়েছে দুর্লভ প্রকৃতির এক জলাভূমি। সিলেটে ঘুরতে আসা অধিকাংশ মানুষই এখন সেই জায়গাটি ভ্রমণ করা তাদের শিডিউলের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে ফেলেছেন। কারণ গোটা পৃথিবীতে -জাতীয় মাত্র ২২টি জলাভূমি রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় রয়েছে মাত্র দুটি। তার একটি হলো আমাদের রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। এখন কথা হলো, দূরদূরান্ত থেকে যে মানুষগুলো রাতারগুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে, তারা কি শুধুই চোখের দেখা দেখে চলে যাবে? গোটা দুনিয়ায় এমন প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে কীভাবে ভ্যালু অ্যাড করে পর্যটকদের সন্তুষ্টি বৃদ্ধির পাশাপাশি আয় বাড়ানো যায় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান রাখা যায়, সে বিষয়ে অনেকে সচেষ্ট রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাতারগুলকে কেন্দ্র করে বড় একটি প্রকল্প হতে পারে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জীব উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণাগার এখানে স্থাপন করা যেতে পারে। কারণ যেসব দুর্লভ প্রজাতির গাছপালা জীবজন্তু এখানে রয়েছে, সেগুলোর ওপর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকেও অসংখ্য গবেষক এখানে এসে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হবেন। বিদেশী ভ্রমণকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও সহজ হবে। তাছাড়া সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য জলাভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রজাতির ছবি এবং অন্যান্য উপাদান নিয়ে একটি বিশেষ জাদুঘর স্থাপন করা খুবই সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন -জাতীয় দর্শনীয় স্থানে অডিও-ভিজ্যুয়াল অসংখ্য বিষয় দৃষ্টিনন্দনভাবে তুলে ধরার ব্যবস্থা রয়েছে। উদ্যোগ একজন ভ্রমণকারীকে আনন্দ দেয়ার পাশাপাশি পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের প্রতি সচেতন করে তুলতে সাহায্য করে। তাছাড়া ভ্রমণকারীদের জন্য সেখানে একটি কমপ্লেক্স স্থাপন করা জরুরি। সেখানে ভ্রমণকারীদের বিশ্রাম, খাবারদাবার এবং অন্যান্য বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার। কারণ দূর-দূরান্ত থেকে একজন মানুষ কষ্ট করে সেখানে এসে আধা ঘণ্টা নৌকায় ঘোরার পরে যদি আর দেখার কিছু না থাকে, তা অনেকেরই মানসিক কষ্টের কারণ হয়। তাই রাতারগুলভিত্তিক বিষয়গুলোকে সংশ্লিষ্ট করে ভালো একটি প্রকল্প হতে পারে।

সিলেট নানা পক্ষের কাছে নানাভাবে আকর্ষণীয় ভ্রমণকেন্দ্র। প্রকৃতিপ্রেমীরা যেমন এখানে খুঁজে পান মুগ্ধ হওয়ার মতো অসংখ্য উপাদান, ঠিক তেমনিভাবে আত্মার শান্তি সন্ধানীরা এটাকে গণ্য করেন এক তীর্থকেন্দ্র হিসেবে। কারণ হজরত শাহজালাল, শাহপরানসহ অসংখ্য আধ্যাত্মিক পুরুষ এখানে শুয়ে আছেন। ফলে পর্যটক আসার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদগুলোর বাইরে এখানে এখন পর্যন্ত খুব উল্লেখযোগ্য কোনো আকর্ষণ গড়ে ওঠেনি। অথচ সেটা করা গেলে আনন্দের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্ঞানলাভের দারুণ সুযোগ সৃষ্টি হতো। যেমন সিলেট বাংলাদেশের অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এলাকা হওয়ার পরেও এখানে সেগুলো সংরক্ষণ প্রদর্শনের জন্য কোনো জাদুঘর নেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঘুরতে আসা মানুষদের পাশাপাশি এলাকায় বসবাসরতদের জন্য জাতীয় জাদুঘরের আদলে একটি মিউজিয়াম স্থাপন করা গেলে তা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সংরক্ষণ বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

সিলেটে একটি পূর্ণাঙ্গ চিড়িয়াখানা থাকা অত্যন্ত জরুরি। যদিও এখানে লাওয়াছড়া, সাতছড়ি বন, রেমা ক্যালেঙ্গা, রাতারগুলের মতো প্রাকৃতিক স্থান রয়েছে, যেখানে বন্য পশুপাখির দেখা মেলে। কিন্তু সেগুলোয় ভ্রমণের মতো সময়-সুযোগ সহসা মেলে না। সম্প্রতি টিলাগড় ইকোপার্কে কিছু প্রাণী যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সিলেট যে মাত্রায় বিকশিত হচ্ছে, তার তুলনায় সেটা অপ্রতুল। ফলে পূর্ণাঙ্গ একটি চিড়িয়াখানা স্থাপন করলে বিশেষত শিশুদের বিনোদনের পাশাপাশি প্রাণিজগৎ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানলাভের দারুণ এক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

সিলেটে শিশুদের জন্য রয়েছে ওসমানী শিশুপার্ক। সেখানে শিশুদের আনন্দদানের আয়োজনে চেষ্টার ত্রুটি নেই। কিন্তু তার জায়গা এত সীমিত যে একটার ওপর আরেকটা রাইড স্থাপন করেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। শহরের প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় সিলেটে স্থায়ীভাবে বসবাসরতদের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ পর্যটক সেখানে পরিবার নিয়ে ঘুরতে যায়। তাছাড়া প্রবাসীদের অধিকাংশই অন্তত একবার শিশুদের নিয়ে সেখানে যায়। প্রতিষ্ঠাকালে সেটা হয়তো ঠিকই ছিল। কিন্তু এখন সিলেটের যে পরিসর হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে শহরের কাছাকাছি বড় কোনো জায়গায় আধুনিক ডিজাইনে একটি শিশুপার্ক স্থাপন করা জরুরি। বর্তমানে ওসমানী পার্কে মাঝেমধ্যে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় রুচিশীল মানুষরা সেখানে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।

একসময় সিনেমা দেখা মানুষের বিনোদনের বড় অনুষঙ্গ ছিল। এখন তা লক্ষণীয় মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। অনেক দিন থেকেই সিনেমা হলের পরিবেশ, চলচ্চিত্রের গুণগত মান ইত্যাদি কারণে আর সপরিবারে তো দূরের কথা, রুচিশীল মানুষ একাও সিনেমা হলমুখো হচ্ছে না। কিন্তু গণহারে সিনেমা দেখার প্রবণতা হ্রাস পেলেও কাস্টমাইজড একটি দর্শক শ্রেণী এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে। তাদের জন্য বিশেষায়িত প্রেক্ষাগৃহ স্থাপনের উদ্যোগ প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে। ফলে ঢাকায় সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা এখন ক্রমে বাড়ছে। সিলেট শহরে এমন একটি উদ্যোগ হলে আমার ধারণা তা বিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হবে। কারণ এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসকারীদের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশী দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে ঘুরতে আসা মানুষদের সন্ধ্যার পর কোনো রেস্টুরেন্টে বসে সময় কাটানো ছাড়া সত্যিকার অর্থে তেমন কিছু করার থাকে না।

তাছাড়া শিল্পোন্নত দেশের আদলে একই ভবনে বেশ কয়েকটি প্রজেকশনের আলাদা আলাদা ব্যবস্থা থাকলে সিনেমাপ্রেমীরা সেখানে গিয়ে পছন্দের মুভিগুলো দেখতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, তারা তো স্মার্টফোন বা কম্পিউটারেই সেগুলো দেখতে পারছে। পয়সা খরচ করে আবার সিনে বা মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে দেখবে কেন! কিন্তু ঢাকায় সিনেপ্লেক্স স্থাপনের প্রবণতাই আমাদের জানান দিচ্ছে যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সেগুলোকে ভ্যালু দিচ্ছে। তাছাড়া ঘরের কোণে মুখ গুঁজে একটা মুভি দেখা আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বা বন্ধুবান্ধবসহ বেশ কয়েকজন মিলে বড় পর্দায় মুভি দেখার মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই এমন কিছু উদ্যোগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখতে পারেন। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর আবেদন হ্রাস পায়। যে ফ্যাক্টরকেই দোষারোপ করি না কেন, পরিবর্তন হচ্ছে এবং হবে। সেটাই স্বাভাবিক। সেটা নিয়ে হা-হুতাশ করে বা কোনো পক্ষকে অভিযুক্ত করে সাময়িক তৃপ্তি লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব মোকাবেলা করা যাবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে পাবলিক লাইব্রেরিগুলো অনেকটা ক্রান্তিকাল পার করছে। গতানুগতিক বইপ্রেমী প্রজন্মের এখন বার্ধক্যকাল চলমান। তারা নানা জটিলতা, সমস্যায় আলাদাভাবে সময় বের করে আর পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতে পারেন না। অন্যদিকে তরুণ প্রজন্ম নানা আকর্ষণ উপেক্ষা করে আর লাইব্রেরির দোর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ফলে বিশাল অবকাঠামো, উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বইয়ের সংগ্রহ কিংবা নানা উদ্যোগ আর তাদের আকর্ষণ করতে পারছে না।

অথচ এখনকার তরুণরা একেবারে পড়ছেন না তা কিন্তু নয়। বরং তাদের অনেকেই এমন বই পড়ছেন, যা তাদের সমালোচকরা ওই বয়সে কল্পনাও করতে পারতেন না। এর বড় প্রমাণ হলো, নীলক্ষেতে শত শত বেস্টসেলার বইয়ের ইকোনমি ভার্সনের উপস্থিতি। এমনকি বিশ্বময় সদ্য আলোচনায় আসা বইগুলো বিক্রেতারা রাতারাতি হাজির করছেন। বেচাবিক্রিও বেশ ভালো। তাহলে যে তরুণরা টিউশনির পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনছেন, তারাও কেন পাবলিক লাইব্রেরির দরজা মাড়াচ্ছেন না? খুব সহজ জবাব হলো, তাদের রুচি পছন্দের প্রতিফলন সেগুলোয় ঘটছে না। এমন লাইব্রেরিগুলো ২০-৫০ বছরের পুরনো সংগ্রহ নিয়ে বসে আছে। আর নতুন যা কিনছে তা নিতান্তই নানামুখী চাপে। সাধারণত মানসম্মত বই আর সেখানে প্রবেশ করছে না। ফলে বেশকিছু ঝকঝকে মলাটের বই দেখিয়ে তারা দাবি করতেই পারেন যে তারা লেটেস্ট বইও রাখছেন। কিন্তু সত্যি কথা হলো, রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক চাপে রাখা ওই গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে তরুণ প্রজন্মের আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। ফলে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হচ্ছে, কিন্তু তা থেকে উপকার পাওয়া যাচ্ছে না।

ব্যাপারে আমার প্রস্তাব হলো, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে সিলেট শহরে একটি নলেজ সেন্টার স্থাপন করা হোক। সেখানে দেশী-বিদেশী বইয়ের পাশাপাশি অত্যাধুনিক কম্পিউটারে গতিশীল ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। সেখানে আড্ডা দেয়া চা-কফি খাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। বর্তমান সময়ে তরুণরা যা পছন্দ করেন, দৈনন্দিন জীবনে তারা যেভাবে চলতে অভ্যস্ত, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে পণ্য অফার করা হোক। সেখানে শিশুদের জন্য আলাদা জোন, বয়স্কদের জন্য আলাদা কালেকশন থাকবে। তাদের রুচি পছন্দ মোতাবেক বই, ম্যাগাজিন অন্যান্য ডকুমেন্ট থাকবে। শিশুদের খেলার ব্যবস্থা থাকবে। তারা রঙ-তুলি দিয়ে ছবি আঁকবে। এমন আয়োজনগুলো থাকলে তবেই না আগামী প্রজন্ম বইকে ভয় পাবে না। সবাই শুধু সমালোচনা করছি যে তারা ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। কিন্তু তাদের বিকল্প কিছু অফার না করে সমালোচনা করা অনেকটা দায় এড়ানোর শামিল। এত বড় এক শহরে একটা আর্ট গ্যালারি নেই, নিয়মিত প্রদর্শনীর কোনো ব্যবস্থা নেই। মেলা বা উৎসব বছরে হাতেগোনা দু-একটা। সেক্ষেত্রে মানুষের দম ফেলার সুযোগ সৃষ্টিতে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবা দরকার।

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন