সাম্প্রতিক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২০

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম কোনো রাষ্ট্রনীতি বা রাজনীতি নেই—কথাটা আপাত সত্যি। কিন্তু বর্তমান গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটা সংস্কার অথবা বিকল্প এখন বের হলে ভালো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক গুণীজনরা ভবিষ্যতে মিলে যদি বর্তমান গণতন্ত্র ও রাজনীতির আইনসম্মত ও যুক্তিসংগত বিকল্প বা সংস্কার দিয়ে যেতে পারেন, তার একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে পারে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ কল্যাণে। গণতন্ত্রের অজুহাতে এখন প্রায় অযোগ্য, অদক্ষ ও অপদার্থ যে কেউ জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিও হচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের সবাই কমবেশি একটি গণতান্ত্রিক দেশ বা রাষ্ট্র বলেই জানে। সেই গণতন্ত্রেও ভূত-পেতনি বাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সব রকম সুস্থ, নৈতিক ও মানবিক মানদণ্ডে একজন অযোগ্য ও অপদার্থ ব্যক্তি। কিন্তু তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন প্রেসিডেন্ট, বলতে গেলে এক অর্থে সারা দুনিয়ারই প্রেসিডেন্ট! এত বিশাল ক্ষমতা ও পদের এ ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পেশাগত, মনস্তাত্ত্বিক সব আচার-আচরণই অত্যন্ত নিম্নমান ও রুচির বলা যায়। গত আগস্টের পর দেখা যাচ্ছে শুরুতে ডেমোক্রেটিক পার্টির যে ২০ জন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন, তা এখন জনসমর্থনের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে ১০ জনে দাঁড়িয়েছে। জনসমর্থনে ডেমোক্রেটিক পার্টির চূড়ান্ত বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গড়াতে গড়াতে শেষ পর্যন্ত একজনই পাবেন দলের প্রার্থিতা, প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের অনুমোদন। এখনো বেশকিছু সময় আছে। ১৭ নভেম্বরের এক হিসাবে দেখা যায়, প্রথম সারিতে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে আছেন ইন্ডিয়ানা রাজ্যের পেটি বুটেজিজ, সিনেটর বার্নি সেন্ডার্স (ভারমন্ট), এলিজাবেথ ওয়ারেন (ম্যাসাচুসেটস) ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত সপ্তাহেই এ লড়াই বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দিয়েছেন আরেক ধনী ব্যক্তি, নিউইয়র্ক রাজ্যের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ। ব্লুমবার্গের অর্থ-সম্পদ অনেক। গত এক সপ্তাহের খবরে জানা যায়, ব্লুমবার্গ তার প্রচারের জন্য এরই মধ্যে ৩৭ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। এ বিষয়ে অনেক স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকের মতে, ‘Money can’t buy your happiness but it can rent you a place on the debate stage.’ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এ লড়াইয়ে মাইকেল ব্লুমবার্গের জন্য মঞ্চে একটু স্থান দিতে পারলেও তার স্বপ্ন বা ইচ্ছা পূরণে সেটা সহায়ক হবে কিনা, বলা কঠিন। বরং এটা ট্রাম্পকেই বেশি সাহায্য করতে পারে ডেমোক্র্যাট অন্য প্রার্থীর ভোট কেটে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন লড়াইয়ে তিনটি মৌলিক বিষয় বা দিক আলোচনায় গুরুত্ব দিচ্ছি। ১. প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা (ইলেকটেবিলিটি), ২. ভোটারদের জনমিতিক চরিত্র এবং ৩. ভোটারদের আস্থা ও বিশ্বাস। 


১. প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা: ২০০৮, ২০১২—সময়ে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা পরিমাপে একটা আদর্শিক চরিত্র, প্রার্থীর কাজের অভিজ্ঞতা, ইতিবাচক ক্যারিশমা, নেতৃত্ব দেয়ার চারিত্রিক বলিষ্ঠতার বিষয়গুলো প্রাধান্য পেত। ২০১৬ সালের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদ বা আসনে এখনকার মতো আপাদমস্তক ব্যক্তিতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস এবং ক্ষমতা প্রয়োগে অতি উৎসাহী কাউকে হোয়াইট হাউজে দেখিনি। ২০১৬ সালে এসে যা দেখছি, এটা এক নতুন চমক। আগে যার রাজনৈতিক কোনো দল ছিল না, একমাত্র রিয়াল এস্টেট ব্যবসাই যার প্রধান মূলধন এবং পরিচয়, সেই ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রিপাবলিকান অন্য সব অভিজ্ঞ, চৌকস, উচ্চশিক্ষিত প্রায় ১৪-১৫ জন প্রার্থীকে ধরাশায়ী করে ফেলেছিলেন। চূড়ান্ত বাছাই পর্বে তাই রিপাবলিকানদের পক্ষে ট্রাম্পই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেন। তার প্রতিপক্ষের প্রার্থী ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির হিলারি ক্লিনটন। হিলারির প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে হেরে যান ট্রাম্পের কাছে। তবে উল্লেখ করতেই হবে যে হিলারি সেই লড়াইয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ‘পপুলার’ ভোটে (প্রায় দুই লাখ ভোটে) এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতিতে ইলেকটোরাল ভোটে হিলারি পরাজিত হন। এরও কিছু কারণ ছিল। যাহোক, বর্তমান আলোচনায় সে প্রসঙ্গ নিয়ে লিখছি না। নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা বা প্রার্থীর ইলেকটেবিলিটি নিয়ে লিখছি। ইলেকটেবিলিটি বা নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতার পরিসরে আরো দুটি ক্ষেত্র আছে—ক. প্রার্থীর সততা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আদর্শগত অবস্থান। জনমানুষের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত যুক্ততা, অভিজ্ঞতা। খ. প্রার্থীর প্রতি ভোটারদের বাহ্যিক রাসায়নিক (কেমিস্ট্রি) সম্পর্ক। ভোটারদের ইমপালসিভ (অস্থিরতা) চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং দলীয় দাসত্বের এক প্রকার শোডাউন বা দৃশ্যত প্রকাশ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীর ইলেকটেবিলিটির বিবেচনায় এসব ভূমিকা রাখে। উল্লিখিত প্রথম ক্ষেত্রটি ধীরে ধীরে প্রায় অকেজো হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল তো তা-ই বলে। এখন প্রার্থীর এ বিষয়ে যোগ্যতার লড়াইয়ে বা প্রশ্নে একটা বড় প্রভাব রাখে নাগরিক বা ভোটারদের দেশপ্রেম নয়, প্রায় ক্ষেত্রেই দেশের চেয়ে নির্দিষ্ট দলের এবং তার নেতানেত্রীর প্রতি সমর্থকদের দাসত্বের। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন লড়াইয়ে আপাতত দেখা যাচ্ছে প্রার্থীর যোগ্যতা বা নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা বাছাইয়ের বৈশিষ্ট্যে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে এক ধরনের জাতিরাষ্ট্রের উত্তেজনা, অস্থিরতা এবং ভয়, সন্দেহ ও অদূরদর্শিতা প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা আছে। ভোটারদের এ কেমিস্ট্রি যে প্রার্থীর প্রতি অধিক ক্রিয়াশীল হবে অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায়, তার নির্বাচিত হওয়ার যুক্ততা বেশি হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্র নয়। এ দেশটাকে সবসময় ইতিহাসবিদরা অভিবাসীদের দেশ বলেছেন এবং বহির্বিশ্ব তা-ই জানে ও বলে। ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইলেকটেবিলিটির প্রশ্নে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ বলতে ইসলাম বিরোধিতার মনস্তাত্ত্বিকতা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। সঙ্গে যুক্ত হতে পারে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক স্বার্থের কূটনীতি। প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতায় সততা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত মান, সুস্থ মনস্তাত্ত্বিকতার সংস্কৃতি বা প্রভাব দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এগুলো গত কয়েক যুগ রাষ্ট্র ও রাজনীতির বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক আরো দেশে যা দেখছি, তার দৃশ্যত বা বাস্তবতার কথা, কোনো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা বাছাইয়ে উল্লিখিত দুই ক্ষেত্রের কোনটি বেশি কার্যকর হবে, এ মুহূর্তে বলা না গেলেও আশঙ্কা হয়, আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে বা যিনিই হবেন, তার মধ্যে কোন আদর্শটি তার সমাজসেবায় ভূমিকা রাখবে। আবারো অসুরের কাছে সুর হেরে যায় কিনা। প্রার্থীর নির্বাচনের যোগ্যতায় অনেক দেশে এখন যেন অসুস্থতাই সুস্থতার লক্ষণ। ২. জনমিতিক চরিত্র: এর নানা মুখ বা দিক আছে। যেমন বর্ণ, ধর্ম, অর্থনীতি, দলীয় বিভক্তি, শ্রেণী স্বার্থ ইত্যাদিকে এক্ষেত্রে নির্দেশ করা যেতেই পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনমিতিক চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য এর অভিবাসী চরিত্র। এ জাতিগোষ্ঠীর কোনো সমগোত্রীয় (হোমোজেনেটিক) চরিত্র নেই। এ সমাজ একটি বহুধাবিভক্ত (হোট্রোজেনিক) সমাজ ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। বিষয়টা এ দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জীবনযাপনেও সুস্পষ্ট। এ নৃতাত্ত্বিক দিকটি মার্কিনি জনমিতিক চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমেরিকান আমেরিকান বলে এখন কোনো সুনির্দিষ্ট ভূমিপুত্র নেই। এখানকার নাগরিকদের কেউ ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, রাশান, ইউরোপীয়, এশিয়ান আদিবাসী। এর সাংস্কৃতিক দিক নিয়েও বলা হয়, মেলটিং পট (পাত্র) বা সালাদ বোল। স্থানীয় ও জাতীয় বা রাজ্যের নির্বাচনের সময় দেখা যায় প্রার্থীরা অভিবাসীদের অনেকের ধর্মীয় ও জাতীয় নানা অনুষ্ঠানে গিয়েও তাদের সমর্থন নেয়ার চেষ্টা করেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় শহর বা স্টেটে বাংলাদেশী-আমেরিকানদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংক বাড়ছে। এতে ভোট প্রার্থীরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশী-আমেরিকানদেরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জনমিতিক চরিত্রে বাংলাদেশী-আমেরিকানদের প্রভাব বাড়বে। এই বহুধাবিভক্ত সমাজে ইহুদি-আমেরিকানদের আধিপত্য কোনো অংশে কম নয়। যে কারণে দেখা যায়, ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষার্থে মার্কিন প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার ও উৎসাহ থাকে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও উল্লিখিত জনমিতিক চরিত্রের একটা প্রভাব ছিল। মার্কিন ভোটারদের কাছে হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে ট্রাম্পকে। কারণ জনমিতিক দর্শনে এ দেশের অভিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈধ ও অবৈধ বাস্তবতার ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গগোষ্ঠীর মধ্যে একটা জাতিগত নিরাপত্তাহীনতা এবং ভবিষ্যতে সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়ারও ভয় কাজ করে। সেই ভয়ের লড়াইয়ে ভোটারদের একাংশ রিপাবলিকান অন্যান্য যোগ্য প্রার্থীর তুলনায়ও অধিক যোগ্য মনে করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ২০১৬ সালে ডোনান্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় অভিবাসী বিরোধিতা, ধর্ম (ইসলাম) বিদ্বেষ এবং তথাকথিত আমেরিকাই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ভোটারদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন। আরেকটা বিষয়ও উল্লেখ করা যায় এ বিষয়ে। সেটা হলো, এখনকার অধিবাসীদের মধ্যে অশ্বেতাঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য এবং তাদের প্রতি এক ধরনের উপেক্ষা দৃষ্টিভঙ্গি এর জনমিতিক চরিত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি শ্বেতাঙ্গদের জনমিতিক চরিত্র প্রেসিডেন্ট ভোট প্রদানে প্রভাব রাখে। আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর জনমিতিক চরিত্র বিভক্ত। [চলবে]


 


মাহমুদ রেজা চৌধুরী: রাজনীতি বিশ্লেষক 


[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন