অপরাধ করেও নাগালের বাইরে যেসব ধনকুবের

চলতি বছরের ঠিক শেষ মুহূর্তে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে জাপান থেকে পালিয়ে যান একদা গাড়ি শিল্পেরলৌহমানবহিসেবে খ্যাত কার্লোস গোন। আর্থিক অসদাচরণের অভিযোগে বিচারের অপেক্ষায় থাকা জামিনে মুক্ত গোন গৃহবন্দি ছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একটি বেসরকারি উড়োজাহাজে অডিও সরঞ্জামের জন্য ব্যবহূত বাক্সে করে বৈরুত পৌঁছান তিনি। নিশান মোটর কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান বিলিয়নেয়ার নন, তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ডলার, কিন্তু গোনের সাহসী পলায়ন স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে বিভিন্ন সময় আরো অনেক বিলিয়নেয়ার সাবেক ধনকুবের দেউলিয়া হয়েছেন, পলাতক হয়েছেন এবং সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আইন ভেঙেও নাগালের বাইরে থাকতে পারছেন। এমন কয়েকজন ধনকুবেরের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন :

মার্ক রিচ

পেছনের গল্প: বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে জন্ম, বড় হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া নিউইয়র্কে। ১৯৫৪ সালে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফিলিপ ব্রাদার্সের একটি মেইলরুম গিগের জন্য নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে বাদ পড়েন রিচ। ১৯ বছর পর ১৫ লাখ ডলার বোনাস না পাওয়ার অভিমান থেকে নিজের কোম্পানি শুরু করেন রিচ, যার নাম দেন মার্ক রিচ অ্যান্ড কোম্পানি। ১৯৮০ সালে আনুমানিক ২০ কোটি ডলার নিট সম্পদ নিয়ে ফোর্বস ৪০০-এর সর্বপ্রথম তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি।

পটভূমি: ১৯৭৯ সালের নভেম্বরেইরানি জিম্মি সংকটে পর একটি জটিল স্কিম পরিকল্পনা করেন রিচ। তেহরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি তেল ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করেন রিচ। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে মার্ক রিচ অ্যান্ড কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী হয়ে ওঠে ইরান।

পালিয়ে থাকা জীবন: ১৯৮৩ সালে নিউইয়র্ক থেকে পালিয়ে সুইজারল্যান্ড যান রিচ। একই বছর নিউইয়র্কের এক তরুণ, উঠতি কৌঁসুলি রুডি গিউলিয়ানি ৬০টির বেশি অভিযোগ আনেন মার্ক রিচের বিরুদ্ধে, যার মধ্যে ছিল ওয়্যার মেইল প্রতারণা, আয়কর ফাঁকি, কালোবাজারি ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের মতো অভিযোগ।

তবে রিচের জীবনে এসব অভিযোগের তেমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। সুইজারল্যান্ডে পৌঁছানোর এক বছর পর নিজ মালিকানাধীন রেস্তোরাঁয় পার্টির আয়োজন করতে দেখা যায় তাকে। নামিদামি স্কি ক্লাবেরও সদস্য হন।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ পর্যন্ত বাজারটিতে ব্যবসা চালিয়ে যান, যা

তাকে ১৯৯৯ সালে বিলিয়নেয়ারদের তালিকায় নিয়ে আসে।

পারিবারিক সম্পর্ক: ধারণা করা হয়, রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রাহক হিসেবে সাবেক স্ত্রী ডেনিস আইজেনবার্গের পরিচিতি ২০০১ সালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের রিচকে ক্ষমা করার পেছনে কাজ করেছে। এর পর নিজের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের চেষ্টা করেন রিচ। ২০১৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে ইহুদি কল্যাণ লিউকেমিয়া গবেষণায় ১০ কোটি ডলারের বেশি দান করে যান তিনি।


থাকসিন সিনাওয়াত্রা

পেছনের গল্প: নব্বইয়ের দশকের তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা থাকসিন আইবিএম কম্পিউটার কেনা পুলিশ বিভাগে ইজারা দেয়ার মূলধন জোগাড় করেছিলেন পরিবার বন্ধুমহল থেকে। তার বাবা ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য। সে সময় আইবিএম থাই বাথের বদলে ডলারে পেমেন্ট নেয়া দুই পক্ষের চুক্তিই ভেঙে যাওয়ার মুখে ছিল। এক দশক পর সিনাওয়াত্রা কম্পিউটার অ্যান্ড কমিউনিকেশনসের ৩০ তলা ভবনের প্রধান কার্যালয়ে বসে থাকসিনযোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণবলে মন্তব্য করেছিলেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তার সম্পদের পরিমাণ ১০ অংকে দাঁড়ায়। আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে ২০০১ সালে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করে। ২০০৬ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে একটি সিঙ্গাপুরি কোম্পানির কাছে নিজের সিন করপোরেশন বিক্রি করে দেন। ঘটনায় সৃষ্ট জনরোষ শেষ পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থানের দিকে গড়ায়।

পটভূমি: পদচ্যুত নির্বাসিত হওয়ার পর থাকসিনের অনুপস্থিতিতে থাইল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতির দায়ে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। এছাড়া আরো দুটি অভিযোগে কারাদণ্ড দীর্ঘায়িত হয়। তবে রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে জোর সামালোচনা ওঠে।

পালিয়ে থাকা জীবন: ১৭ বছর আগে দেশ ত্যাগ করার পর থেকে থাকসিনের সম্পদের পরিমাণ বেড় ১৯০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। যার প্রধান উৎস রিয়েল এস্টেট কুখ্যাত সিন করপোরেশন বিক্রির অর্থ। ২০১২ সালে দুবাইয়ে বসবাস করার সময় থাকসিন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সমুচিত জবাব দেবেন বলে হুমকি দেন। এখনো মরু শহরে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তিনি।

পারিবারিক সম্পর্ক: ২০১১ সালে থাকসিনের বোন ইংলাক থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। তবে ভাইয়ের মতো একই ভাগ্যবরণ করে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনিও। ইংলাকের বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।


জোসেফ লাউ

পেছনের গল্প: কানাডার উইন্ডসোর ইউনিভার্সিটির পাঠ শেষে পারিবারিক সিলিং ফ্যান উৎপাদন ব্যবসায় যোগ দিতে হংকং ফেরেন লাউ। আশির দশকের শেষদিকে নিজের সিলিং ফ্যান কোম্পানিএভারগোপ্রতিষ্ঠার পর রিয়েল এস্টেট হোটেলে ব্যবসা সম্প্রসারিত করেন।

পটভূমি: ২০১৪ সালে ম্যাকাওয়ের আদালত লাউয়ের অনুপস্থিতিতে তাকে বিমানবন্দরের পাশে এক খণ্ড জমির জন্য এক সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেন। কিন্তু ম্যাকাও হংকংয়ের মধ্যে প্রত্যাবর্তন চুক্তি না থাকায় হংকংয়েইগৃহবন্দিআছেন লাউ।

পালিয়ে থাকা জীবন: হংকংয়ে আটকে পড়লেও চুপ করে থাকেননি লাউ। বিচারের দুই বছর পর স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপনে সম্পর্ক ভাঙার গল্প প্রকাশ করেন তিনি। যেখানে সে সময় পাঁচ সন্তানের জনক ৬৫ বছর বয়সী লাউ জানান, তার সাবেক প্রেমিকাকে তিনি ভালোভাবেই রেখেছিলেন এবং প্রায় ২৬ কোটি ডলারের গহনা অন্যান্য উপহার দিয়েছেন।

 

সূত্র: ফোর্বস     চলবে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন