পর্যালোচনা

একটি নিস্তেজ ও প্রবঞ্চনাপূর্ণ দশক

কৌশিক বসু

লেখাটি আমি একজন পেশাদার অর্থনীতিবিদ কিংবা কোনো নীতিনির্ধারক হিসেবে লিখছি না। লিখছি অসীম মহাশূন্যে ঘূর্ণায়মান একটি ক্ষুদ্র গ্রহের বাসিন্দা হিসেবে, যদিও মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কদাচিৎ বুঝি। তাই আমি লিখছিঅ্যাজ দ্য ক্লেভার হোপস এক্সপায়ার/অব লো ডিজঅনেস্ট ডিকেড’, কিংবা যেমনওয়েভ অব অ্যাঙ্গার অ্যান্ড ফিয়ার/সারকুলেট ওভার দ্য ব্রাইট/অ্যান্ড দ্য ডার্কেনড ল্যান্ডস অব দ্য আর্থ।৮০ বছর আগে ডব্লিউএইচ অডেন তারসেপ্টেম্বর ওয়ান, ১৯৩৯নামের কবিতায় লাইনগুলো লিখেছিলেন। যদিও আজ এত বছর পর আমরা নিজেদের ঠিক একই অবস্থায় আবিষ্কার করছি।

গত দশকটি যতই এর সমাপ্তি রেখার দিকে ধাবিত হয়েছে, বিশ্বের প্রধান প্রধান অংশগুলো ততই সংঘাতের ঘূর্ণিতে জড়িয়েছে। হঠাৎ ভেঙে পড়েছে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের শৃঙ্খলা আর বিন্যাসগুলো। ধর্ম, বর্ণ রাজনৈতিক আদর্শের ধুয়ো তুলে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে বিভক্তি। সহিংসতা বৃদ্ধির ফলে লাখ মানুষ বাঁচার জন্য অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও নতুন বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের, নবোদ্যমে সক্রিয় জাতীয়তাবাদ আর সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদ তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে।

আমি এতটা বোকা নই যে, ভেবে নেব অচিরেই অবস্থার অবসান ঘটবে। তাছাড়া অতীতের মতো পরিবেশ আর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কিনার থেকে ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্ব এর উন্নতি অগ্রগতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখবেএবার সম্ভবত এমনটা না- ঘটতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেল এমন প্ররোচক চিন্তার বিপদ সম্পর্কে তারদ্য প্রবলেমস অব ফিলোসফি’-তে উল্লেখ করেছেন, ‘যে লোকটি রোজ মুরগিকে খাইয়ে দেয়, সে- কিন্তু একদিন এটির ঘাড় মটকে দেয়, যদিও প্রকৃতির অভিন্নতার বিষয়ে একটি বিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন মুরগির জন্য উপকারী হতো।অডেন যেমন বলেছেন, ‘পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে আরো বেশি খারাপ হতে পারেএমন সম্ভাবনাকে আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে।

তবে আমাদের কিন্তু আশা ছাড়লে চলবে না। বর্তমান সময়গুলো শুধু বিপজ্জনকই নয়, অনিশ্চিতও। পৃথিবী একটি চৌরাস্তায় উপস্থিত, এখান থেকে একটি বাঁকবদল সবকিছুই বদলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে নতুন দশকের সূচনা মূলত খানিক বিরতি অনুচিন্তার উপলক্ষ মাত্র। আমাদের ভাবার সময় হয়েছে যে, দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক সমাজগুলো কেন ক্রোধ, উন্মত্ততা রাজনৈতিক মূর্খতার পরিপালন করছে, যা কিনা তাদের নিজস্ব ভিত্তিকেই গুঁড়িয়ে দিতে পারে? প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিগুলো কেন ব্যর্থ হচ্ছে? বাণিজ্য দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে কেন? কেন বেকারত্ব বাড়ছে? আর্থিক নীতিকে বিশৃঙ্খল করে তুলছে এবং বৈষম্যের মাত্রা কেন বাড়াচ্ছে?

অতীতেও ধরনের সময় এসেছে। তবে সংজ্ঞায়িত পরিবর্তনগুলো সাধারণত হয় ধীর দুর্ভেদ্য। গাঢ় বিচ্যুতি রেখাটি যখন দৃশ্যমান হয়, তখন তারা একটি জটিল অবস্থায় পৌঁছায়। বর্তমানে আমরা এমনই একটি সময় দাঁড়িয়ে, যেখানে কাউকে না কাউকে অবশ্যই সামাজিক বিজ্ঞান, আমাদের আচরণগত ভিত্তি পছন্দের ভারসাম্যের বিষয়গুলোকে পুনর্বিবেচনায় আনতে হবে। রাসেলের রূপক অর্থে ব্যবহূত মুরগি যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের অবশ্যই তা পারতে হবে: পর্যায়ে আমাদের আত্মসন্তুষ্টি বাদ দিয়ে দুর্দশাগুলো নিয়ে সযত্নে চিন্তা করা জরুরি।

অডেন তার ওই কবিতাটি লেখার ঠিক ১০ বছর আগে অর্থনীতি পরিসংখ্যানবিদ হ্যারল্ড হোটেলিং একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। নির্বাচনী গণতন্ত্র বোঝার জন্য যা পরবর্তী সময়ে একটি চূড়ান্ত নিবন্ধ হয়ে ওঠে। সেখানে তুলে ধরা হয় রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের কাছে যাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। এমনকি ডানপন্থী কিংবা বামপন্থী দলগুলোর তৈরীকৃত পরিস্থিতির মধ্যে খুব সামান্যই পার্থক্য রয়েছে। তত্ত্বটি তুলে ধরে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব রাজনীতিবিদই মধ্যপন্থী ভোটারদের চাহিদা পূরণ করে। আর একঘেয়ে হয়ে ওঠার কারণে ফলাফলগুলো সমালোচিত হতে পারে, তবে তা বিপজ্জনক নয়।

হ্যারল্ড হোটেলিংয়ের কাজগুলো পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিবিদ ডানকান ব্ল্যাক অ্যান্ড অ্যান্থনি ডাউনস কর্তৃক গৃহীত হয় এবং বিংশ একবিংশ শতাব্দী গোড়ার দিকে রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তবে বিশ্বায়ন প্রযুক্তির সংহতিনাশক অগ্রগতির কারণে সর্বদাই আমাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। আর এখন পতন রেখাটি দৃশ্যমান। তাই সত্যিকার অর্থেই আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্রের মডেল নিয়ে মনোযোগসহ চিন্তার সময় উপস্থিত। যদিও বর্তমানের রাজনৈতিক দলগুলো বিদ্বেষ দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি বিশ্বকে তুলে ধরা শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারসাম্য বিন্দুতে এসে মিলিত হওয়ার পরিবর্তে বিপরীত মেরুতে পালাচ্ছে।

বিশ্বায়ন প্রযুক্তির সুস্পষ্ট ফলাফল এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত দূর-দূরান্তের মানুষদের সংযুক্ত করার কারণে বিশ্বের এক স্থানের নীতি সিদ্ধান্তগুলো খুব সহজে বিভিন্নভাবে অন্য অঞ্চলের মানুষদের প্রভাবিত করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে দায়িত্ব পালন করছেন, তা কিন্তু মেক্সিকোর লোকদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ যখন আর্থিক বাজার ঘিরে তারল্য প্রক্ষেপণ করে গোটা বিশ্বেই তার আঁচড় পড়ে। চীনের বিনিময় হারের ছোট্ট একটি সংশোধন অন্য মহাদেশের লাখ মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। গণতন্ত্র মানে যদি হয় এমন নেতৃত্ব নির্বাচন, যারা আপনার কল্যাণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা ধারণ করে, তবে জাতীয় বিভক্ত রাজনীতির মাঝে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণকে অনিবার্য করে তোলে।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণপূর্বক আমরা দেখি লোকেরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিকে তাদের নিজস্ব সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। নিয়তির বিদ্রূপ পরিহাস হচ্ছে, অনেক দেশেই এমনসব রাজনৈতিক নেতা নির্বাচিত হচ্ছেন, যারা শুধু অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন নয়, গণতন্ত্রবিরোধীও।

পর্যায়ে, ডুবতে বসা নৌকাটিকে বাঁচানোর সময় এসেছে। নীতিনির্ধারক, বৈজ্ঞানিক অর্থনীতিবিদরা সর্বাত্মকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দশককে প্রতিহত করতে গ্রহের সব নাগরিকের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আর তা পালনের জন্য যারপরনাই ব্যক্তিস্বার্থ মুক্ত হওয়া জরুরি। আমাদের একটি নৈতিক কাঠামো প্রয়োজন, যেখানে দেখতে আমাদের মতো নয় এমন মানুষ এবং যাদের আগামী প্রজন্মের জন্য সহানুভূতি থাকবে। মনের স্বচ্ছতার পাশাপাশি আমাদের নিজেদের নিয়ে চিন্তা করার সাহসটা জরুরি। যেমনটা অডেন পরামর্শ দিয়েছেন যে, আমাদের কোনোভাবেইকর্তৃত্বের মিথ্যাচারগ্রহণ করা উচিত হবে না। যাবতীয় মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই জোর আওয়াজ তুলতে হবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কৌশিক বসু: কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন