রাজসিক প্রত্যাবর্তন বাঙালির মর্যাদার প্রতীক

মো. আবদুর রহিম

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস প্রতি বছর ফিরে আসে আমাদের মাঝে। বাঙালির জাতীয় জীবনে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিন আমাদের আত্মমর্যাদার শপথ নিতে শেখায়, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জোগায়। এভাবে প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে না হলেও আদর্শগতভাবে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর বিচার, মুক্তি ও নায়কোচিত প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই বঙালি যে বীরের জাতি, তার মর্মার্থ নিহিত রয়েছে। বিষয়টিকে আমরা কয়েকটি আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করতে পারি।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সাত মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রথম গ্রেফতার হন। এরপর পাকিস্তানের সব সরকারের আমলে তিনি অব্যাহতভাবে জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি পাকিস্তানিদের চোখে ছিলেন গাদ্দার, এক নম্বর শত্রু, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদেরশত্রুকে নির্মূল করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন সময়ে বিচারের মুখোমুখি করেন। অনেকবার তাকে কারাদণ্ডাদেশও দেন। এর মধ্যে তাকে দুবার বিশেষ আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমবার ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিশেষ আদালত স্থাপন করে তাকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় হত্যার উদ্দেশ্যে প্রহসনের বিচার শুরু করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা পূর্ববাংলার জনমানুষকে এমনভাবে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করছিল যে পাকিস্তান সরকার দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ষড়যন্ত্রমূলক বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তার ছয় দফা আন্দোলনকে বানচাল করাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু ফল হয়েছিল উল্টো। পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের আসল চেহারা প্রত্যক্ষ করল। ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যুক্ত হলো সর্বস্তরের মানুষ। জনতা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে বসে। এই রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধুকে তারা প্যারোলে মুক্তি দিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। প্যারোল তো নয়-, এমনকি বঙ্গবন্ধু জামিনেও মুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানান। উপায়ন্তর না দেখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিফৌজদারি সংশোধনী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অর্ডিন্যান্স ১৯৬৮ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু বীরোচিতভাবে ফিরে এলেন তার মানুষের কাছে। প্যারোল বা জামিনে মুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বাঙালি জাতিকে মর্যাদার এক বিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত করলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর পরই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারের নির্জন সেলে বন্দি করে রাখে। কারাবন্দি থাকাকালে তিনি পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলেন। বাংলাদেশে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে প্রহসনের বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের সেলে তাকে রাখা হয়। এত কিছুর পরও তিনি মাথা নত করেননি। এদিকে রণাঙ্গনের যুদ্ধে বাঙালি বিশ্বের দরবারে বিজয়ী বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ওদিকে সত্য ও মিথ্যার যুদ্ধে তথা বিচার ও প্রহসনের খেলায় বঙ্গবন্ধু অবিচল থেকে বাঙালিকে করেন মহীয়ান। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে জেলের মধ্যে গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু জেলে ছদ্মবেশে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার রাজা আনোয়ার খান গোপনে জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে শহরের একটি নিরাপদ বাড়িতে স্থানান্তর করেন। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়াল পিন্ডির বাইরে সিহালা রেস্ট হাউজে সদ্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮ জানুয়ারি সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে পাকিস্তানের একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনের উদ্দেশে বিদায় জানান। হিথরো বিমানবন্দরে একজন উচ্চপর্যায়ের ব্রিটিশ কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। দেশের অন্যত্র সফর বাতিল করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ লন্ডন ফিরে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাসায় ঘণ্টাব্যাপী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলেন। লন্ডনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকেঅপরিবর্তনীয় বাস্তবতা বলে উল্লেখ করেন। সেদিন সারা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমের স্পট লাইট ছিল বীর বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের প্রতি। এমনকি তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী কালো পাইপ, পাইপ টেনে ধূমপান করার সময় দৃঢ়চিত্ত কিন্তু অপরূপ ব্যক্তিত্বের মোহনীয় প্রকাশ, তারবডি ল্যাঙ্গুয়েজ’—এসব খুঁটিনাটি বিষয়ও সংবাদকর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বীরোচিত ব্যক্তিত্বের কাছে এক সময়ের বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে খুবই সাধারণ শ্রোতার মতোই মনে হয়েছিল। এমনকি নিজ হাতে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় জানিয়ে ক্ষমতাধর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জাত্যাভিমানী ব্রিটিশদের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে সবকিছু একাকার হয়ে গিয়েছিল। হবেই-বা না কেন? বিশ্বের ইতিহাসে এ রকমভাবে বীরের মতো স্বাধীনতা লাভের গৌরব অর্জন করেছে কয়টি জাতি? এ রকম নেতা কয়টা জাতি তৈরি করতে পেরেছে, যার অনুপস্থিতিতে তার নামে স্লোগানকে বজ মন্ত্র করে পৃথিবীর অন্যতম সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করতে পেরেছে। আমার তো মনে হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম নেতা বিরল, যার উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, মৃত অথবা জীবিত সব পর্যায়ে তিনি সমানভাবে শক্তিশালী। 

লন্ডনে অবস্থানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ করেন। এমনকি তিনি দিল্লি থেকে বিশেষ বিমান পাঠানোর প্রস্তাব করেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে বন্দি ও প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডের ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে বিশ্বজনমত গঠনে ভারতের জনগণ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্ভাব্য সবকিছু করেছিলেন। বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। বন্ধুরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্দেশ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন দিল্লি হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় দিল্লি বিমানবন্দরে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও মন্ত্রিপরিষদের প্রায় সব সদস্য উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান এবং পরবর্তীতে তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়। ভারতের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে যে সম্মান প্রদর্শন করা হয়, সে ধরনের ঘটনাও বিশ্বের কূটনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। মহান জাতির মহান নেতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পথেই সফল কূটনৈতিক তৎপরতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। তিনি লন্ডনেই বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান।  

১০ জানুয়ারি ১টা ৪৫ মিনিটে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের একটি জেট বিমান তেজগাঁও এয়ারপোর্টের মাটি স্পর্শ করার পর লাখ লাখ জনতার জয়বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ হয়। এ যেন বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। সারা দেশ যেন এদিন ভেঙে পড়েছিল ঢাকা এয়ারপোর্টে। ৯ মাস ১৫ দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সারা জীবনের লালিত স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন।

বঙ্গবন্ধু বাঙালির নেতা থেকে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হলেন বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাখলেন অনন্যসাধারণ ভূমিকা। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের নেতা হয়েও বৈশ্বিক রাজনীতিতে গড়ে তুললেন এক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। মাত্র তিন বছরের শাসনকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হলেন। জোটনিরপেক্ষ নীতির মাধ্যমে বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে একটি সুষম কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা বড়ই দুর্ভাগা। বঙ্গবন্ধুর গৃহীত কর্মসূচির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের আগেই আমরা তাকে হারালাম। পথও হারালাম দুই দশকের জন্য। অবশেষে অনেক মূল্য দেয়ার পর জাতিকে আবার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি আমরা তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। তা আবারো প্রমাণ হয়েছে। তার আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কাজেই বঙ্গবন্ধুই হলো বাঙালির প্রথম ও শেষ ভরসা। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন আমাদের মাঝে সঠিক পথের দিশা হয়ে।

 

মো. আবদুর রহিম: সহযোগী অধ্যাপক

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেক্রেটারি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন