লন্ডনে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু

৮ জানুয়ারির সকাল। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলের বলরুম। বক্তব্য রাখবেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। জড়ো হয়েছেন সাংবাদিকরা। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। টেলিভিশন-ক্যামেরার লাইটগুলো ক্ষণে ক্ষণে পরিবেশকে অত্যুজ্জ্বল করে তুলছে

সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব উপস্থিত হয়েছিলেন ২০ মিনিট দেরিতে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শেখ মুজিব কারান্তরালে তার ৪২ পাউন্ড ওজন হারিয়েছেন। কিন্তু তার শরীরের ক্লান্তিকে মুছে দিয়েছে মুক্তির উচ্ছ্বাস।

বলরুমে ঢুকেই তিনি সাংবাদিকদের সম্ভাষণ করেন, ‘জয় বাংলা। আজ আমি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার আনন্দকে বরণ করছি পরম গৌরবের সঙ্গে। আমি স্বাধীনতার যুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। গাঢ় রঙের টিউনিক স্টাইল স্যুট পরিহিত শেখ মুজিবকে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মুক্ত জনগণের মুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সাংবাদিক জেমস মারগ্যাচ লিখেছেন, ৫১ বছর বয়সীবঙ্গপিতার মধ্যে কোনো অসুস্থতার চিহ্ন ছিল না। তার দরাজ কণ্ঠ সবাইকে ছাপিয়ে বিমোহিত করেছিল সবাইকে। সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরের বিবরণ

প্রশ্ন: আপনি ঢাকার পরিবর্তে কেন লন্ডনে এলেন?

মুজিব: আমি বন্দি ছিলাম। এটি পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছে, আমার নয়। আমি এখানে কতক্ষণ থাকব তা জানি না। তবে লন্ডন ত্যাগের আগে আমি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করার আশা করছি।

প্রশ্ন: পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে?

মুজিব: ভুট্টো আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনা করি। আমি তাকে বলেছি, আমার দেশের জনগণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না।

প্রশ্ন: পাকিস্তানিদের নির্যাতনের ব্যাপারে তাদের আপনি কীভাবে অভিযুক্ত করবেন?

মুজিব: পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন অত্যাচার-নির্যাতনে রুদ্ধ করতে চেয়েছে, তারা প্রত্যেকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। পাকিস্তান অত্যন্ত জঘন্য খেলা খেলছে। গণহত্যার দায়ে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আজ যদি হিটলার বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিও লজ্জা পেতেন।

প্রশ্ন: ভুট্টো সম্পর্কে মন্তব্য করুন।

মুজিব: এখন আমার জনগণ স্বাধীন। পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নেই। তাদের আচরণের ব্যাপারে আর কী বলতে পারি? সৈন্যরা যখন আমাকে গ্রেফতার করেছে, তখন আমার ছেলেমেয়েদেরও গ্রেফতার করে অন্তরীণ করেছে, আমার বাড়ি জ্বালিয়েছে। আমি ভুট্টোর সাফল্য ও তার কল্যাণ কামনা করি।

প্রশ্ন: যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

মুজিব: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অবদানের জন্য আমার শুভেচ্ছা জানাই। শুভেচ্ছা জানাই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রতি। আমি গোটা বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানাই। আশা করি আমরা শিগগিরই জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত হব। আমি বিশ্বের অনেক মানুষের প্রতি আমার লাখ লাখ ক্ষুধার্ত, অনাহারী মানুষকে বাঁচানোর আবেদন জানাই। বাংলাদেশ কয়েকশ বছর ধরে শোষণ-বঞ্চনার শিকার। এজন্য ব্রিটেনও অনেকাংশে দায়ী। যদিও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার সুসম্পর্ক বিদ্যমান।

প্রশ্ন: আপনাকে জেলখানায় শারীরিকভাবে কোনো প্রকার নির্যাতন বা খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে?

মুজিব: আমাকে রাখা হয়েছিল বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক জনমানবহীন কারাগারে। তাও সাধারণ কোনো সেলে নয়, ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের সেলে। কোনো দর্শনার্থী নেই, কোনো চিঠি নেই, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। আমাকে নিয়ে বিচারের আনুষ্ঠানিকতা ছিল একজন বেসামরিক নাগরিকের কোর্ট মার্শালের মতো। আমি এখন মুক্ত মানব, কিন্তু বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি জানি না আমি মরব কি বাঁচব। কিন্তু এটা জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। ওই বিচারের প্রহসন যদি এখন চলে তাহলেও আমি মানসিকভাবে মরতে প্রস্তুত।

প্রশ্ন: ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে সংঘাত তাতে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মুজিব: (কিছুক্ষণ চিন্তাক্লিষ্ট থেকে) আমি এখনো বন্দিদশায়। জানি না এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি যখন ঢাকায় ফিরে যাব, তখন আমার জনগণের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে হবে।

প্রশ্ন: পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ব্যাংক, বীমা ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণ করতে যাচ্ছেএ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

মুজিব: এসব বিষয় আওয়ামী লীগের ইশতাহারে অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। আমার সহযোগীরা বাংলাদেশে যা করছে, আমি সে ব্যাপারে অত্যন্ত আস্থাবান। আমি যেকোনোভাবেই আমার স্বাধীনতাকে আবার হারাচ্ছি না। এজন্য আমি যে কারো সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি আছি।

এরই মধ্যে শেখ মুজিব অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যেতে আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। বাংলাদেশে জনগণের মতো এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা এবং স্বাধীনতার জন্যে এত চরম মূল্য আর কোনো জাতি দেয়নি। আমি আগামীকাল বা পরশু আমার দেশে ফিরে যাব। জয় বাংলা।

 

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ জানুয়ারি ১৯৭২

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন