[গতকালের পর]
বাংলাদেশের বিপক্ষে সাইপেন এসপিএ জয়ী হয়েছে। কোম্পানির প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের সঙ্গে ১৯৯৭ সাল থেকে নির্দিষ্ট অংকের সুদও যোগ হয়েছে। নাইকোর ক্ষেত্রেও কি তা-ই ঘটবে? যদি অগ্নিকাণ্ডের দায়ভার/ক্ষতিপূরণ থেকে নাইকো অব্যাহতি পায় এবং নাইকোর গ্যাস বিক্রির পাওনা পরিশোধ করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতায় শুধু শূন্য থাকবে তা নয়, বরং ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। লম্বা সময়ের ওপর ধার্য সুদাসল মিলিয়ে নাইকোর পাওনা পরিশোধ করতে তো হবেই; পাশাপাশি ইকসিডের ট্রাইব্যুনালের মামলার যাবতীয় খরচ ভাগাভাগির দায়ও বর্তাতে পারে বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার ওপর।
কেন এমনটি হচ্ছে? বাংলাদেশে সরকারি সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইনি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয় বলে মনে হয়। তাছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং তো আছেই। তাহলে চুক্তির কোন ধারাবলে নাইকো ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের অগ্নিকাণ্ডের দায়ভার/ক্ষতিপূরণ থেকে অব্যাহতি দাবি করছে? যেহেতু নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাপেক্স/পেট্রোবাংলার গোপন দলিল, তাই এটি আমাদের পক্ষে চিহ্নিত করা মুশকিল। তবে এ বিষয়ের দেশী-বিদেশী গবেষকদের গবেষণা থেকে জানা যায়, আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তিতে নাইকোকে দায়ী করার এমন কোনো ধারা সম্ভবত নেই। প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ১৯৯৭ সালে মাগুরছড়ায় সংঘটিত দুর্ঘটনায় অক্সিডেন্টাল/ইউনোকল/শেভরনকে দায়ী করা যায়নি, কেননা তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত প্রডাকশন শেয়ারিং চুক্তিতে এ রকম কোনো ধারা ছিল না। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর মতে, এ রকম ধারাবিহীন চুক্তিই এ খাতে মডেল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। বহুজাতিক পুঁজির ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য জ্বালানি খাতে বিশ্বব্যাংকের কারিগরি সহায়তার অর্থায়নে ও প্রত্যক্ষ তদারকিতে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে এ মডেল বাংলাদেশের পাবলিক পলিসিতে জায়গা করে নেয়।
ইকসিডের ট্রাইব্যুনালে ও বাংলাদেশের আদালতে নাইকোবিষয়ক মামলার উপরোক্ত বিবরণী বিদেশী বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক আইন, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, দেশীয় আদালতের এখতিয়ার ইত্যাদি নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন হাজির করে। এরই মধ্যে সাইপেম এসপিএ বনাম বাংলাদেশ মামলাটি এসব বিষয়সংক্রান্ত একাডেমিক গবেষণায় একটি বহুল ব্যবহূত উদাহরণ। কোনো সন্দেহ নেই যে নাইকো মামলাও এ তালিকায় যুক্ত হবে। পুঁজিবাদ ও বহুজাতিক করপোরেশনবিরোধী নানা সামাজিক আন্দোলন এ আলোচনায় নানা বিষয় সংযুক্ত করছে: বহুজাতিক করপোরেশনের কর্মকাণ্ডে কি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব খর্ব হচ্ছে? বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে রাষ্ট্রই কি তার সার্বভৌম ক্ষমতার সীমা কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে? নানা আন্তর্জাতিক চুক্তির (যেমন ইকসিড কনভেনশন) পক্ষ হয়ে রাষ্ট্র কি তার আইন-আদালতের এখতিয়ার হ্রাস করছে? বহুজাতিক করপোরেশন কি দেশীয় আদালতের ওপর আস্থা রাখে? তাদের কি এসব আদালতে ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কা আছে? দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তিগুলো এবং আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি কি দেশীয় আদালতের ক্ষমতা কমাচ্ছে? এসব চুক্তি দেশীয় আইনের আওতায় চলমান থাকলেও বিরোধ নিষ্পত্তি কেন আন্তর্জাতিক সালিশি ট্রাইব্যুনালের আওতায় থাকবে? এসব থেকে কে লাভবান হচ্ছে আর কে এর মাশুল দিচ্ছে? এ নিয়ে একাডেমিক আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক আলোচনাও দরকার। কেননা পাবলিক পলিসি নিরূপণে এবং সর্বজনের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এসবের ব্যাপক প্রভাব আছে।
আন্তর্জাতিক আইনের বিশ্বখ্যাত একজন আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য উল্লেখ করে এ আলোচনা শেষ করব। ইকসিডের সালিশি ট্রাইব্যুনালে তার নানা ভূমিকায় (কাউন্সেল, আরবিট্রেটর) কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, পেট্রোলিয়াম সেক্টরে আন্তর্জাতিক সালিশি ট্রাইব্যুনালে (যেমন ইকসিড) উন্নয়নশীল দেশের (যারা বিদেশী বিনিয়োগকারী কোম্পানির হোস্ট রাষ্ট্র) স্বার্থ রক্ষার কাজটি কঠিন হয়ে ওঠে, কেননা এ সেক্টরের কর্মকাণ্ড সংগঠনে এবং পরিচালনায় এদের বেশ দুর্বলতা রয়েছে। এ সেক্টরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন কারিগরি দক্ষতার দরকার, তেমনি নানা অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ এবং চুক্তি পরিচালনার প্রশাসনিক সক্ষমতা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতার দিক থেকে হোস্ট স্টেট এবং বড় বিদিশী বিনিয়োগকারী যেমন একটি আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির মধ্যে প্রকট অসমতা রয়েছে। চুক্তির শর্তাবলি নেগোসিয়েশন এবং পরবর্তীকালে কাজকর্ম সম্পাদন প্রক্রিয়ায় এ অসমতা প্রতিফলিত হয়। হোস্ট স্টেট অনেক দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি (বিআইটি) স্বাক্ষর করে অথচ প্রায়ই দেখা যায় এসব চুক্তিতে বর্ণিত ও তাদের দ্বারা গৃহীত দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র সম্পর্কে তাদের সচেতনতার অভাব কিংবা একটি আন্তর্জাতিক সালিশি ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের ক্ষেত্র (যার প্রয়োগে তাদের সম্মতি আছে বলে প্রতীয়মান) সম্পর্কে তারা সচেতন নয়।
সাইপেম এসপিএ কিংবা নাইকোর মামলার ক্ষেত্রে আমরা এ মন্তব্যেরই প্রতিফলন দেখি।
[শেষ]
ওমর ফারুক: পোস্টডক্টরাল ফেলো
গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ
কুইন্স ইউনিভার্সিটি, কানাডা