বিলম্বিত হতে পারে মেট্রোরেল

শামীম রাহমান

লক্ষ্য ছিল চলতি বছরের ডিসেম্বরেই চালু হবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-) সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়ায় এক বছর পিছিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে চালুর নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু সময় পেছানোর পরও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই কাজের অগ্রগতি। বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সময়াবদ্ধ কাজ শেষ করতে না পারলে মেট্রোরেল চালু আরো বিলম্বিত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেট্রোরেল চালুর উপযোগী করতে অন্তত ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়া প্রয়োজন। বাকি ১০ শতাংশ কাজ মেট্রোরেল চালুর পরও সমন্বয় করা যাবে। হাতে সময় আছে দুই বছরেরও কম। অথচ নির্মাণকাজ শুরুর পর সাড়ে তিন বছরে (গত ডিসেম্বর পর্যন্ত) মেট্রোরেলের ডিপোর অবকাঠামো উন্নয়নকাজের অগ্রগতি হয়েছে ৬০ শতাংশ।

চারটি প্যাকেজে ভাগ করে চলছে প্রকল্পটির উড়ালপথ স্টেশন নির্মাণকাজ। এর মধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের (প্যাকেজ- ) নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। অংশে কিলোমিটারের বেশি উড়ালপথ দৃশ্যমান হয়েছে। উড়ালপথে শুরু হয়েছে রেললাইন ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম (বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন) স্থাপনের কাজ।

অগ্রগতিতে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আগারগাঁও-কারওয়ান বাজার (প্যাকেজ-) কারওয়ান বাজার-মতিঝিল (প্যাকেজ-) অংশ। এর মধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি ৩৬ শতাংশ, কারওয়ান বাজার-মতিঝিলের ৩৮ শতাংশ। দুই অংশেই উড়ালপথের পিয়ারের জন্য চলমান আছে পাইলিংয়ের কাজ। এখনো ১৭৩টি পিয়ারের কাজ বাকি।

মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সরবরাহ কাজের অগ্রগতি ২৯ শতাংশ। ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে গত জানুয়ারি। অন্যদিকে রোলিং স্টক (রেল কোচ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম) সংগ্রহের কাজ এগিয়েছে ২০ শতাংশ।

অগ্রগতির এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়ার কথা বলছেন। যদিও পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যবেক্ষণ বলছে, সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনায় লক্ষ্যের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে মেট্রোরেলের কাজ।

গত বছরের মে মাসে মেট্রোরেল প্রকল্পের ওপর সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল আইএমইডি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি ১৬ শতাংশ পিছিয়ে। সে সময় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য বেশকিছু সুপারিশ করেছিল আইএমইডি। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল ২০২০ সালের আগস্টের মধ্যে ডিপোর কাজ, আগারগাঁও-কারওয়ান বাজার অংশের উড়ালপথ স্টেশন ২০১৯ সালের ডিসেম্বর এবং কারওয়ান বাজার-মতিঝিল অংশের উড়ালপথ স্টেশন বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করা। ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত আটটি ট্রেন একটি উদ্ধারকারী ট্রেন ঢাকায় পৌঁছার সুপারিশও করেছিল আইএমইডি। এসব সুপারিশ করা হয়েছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্য ধরে। পরে সরকার মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্য এক বছর পিছিয়ে দেয়।


এক বছর সময় পেছানোর পরও প্যাকেজভিত্তিক অগ্রগতিতে বেশ পিছিয়ে প্রকল্পটি। ডিপোর অবকাঠামো উন্নয়নকাজ অর্ধেকের সামান্য বেশি এগিয়েছে। মাত্রই শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনের কাজ। এখন পর্যন্ত ঢাকায় কোনো ট্রেন এসে পৌঁছেনি।

সব মিলিয়ে আটটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্পটি। লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ শেষ করতে হলেসবগুলো প্যাকেজের সমানুপাতিক সমন্বিত অগ্রগতি অর্জনজরুরি বলে উল্লেখ করা হয় আইএমইডির নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে প্যাকেজগুলোর অগ্রগতি সমানুপাতিক নয়, সমন্বিতও নয়।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে মেট্রোরেল চালুর জন্য এখনো ২২ মাসের মতো সময় পাচ্ছে সরকার। ঠিকাদারদের কাজের গতি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সংস্থা যদি সঠিক তদারকি করতে পারে, তাহলে এই সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল চালু করা সম্ভব বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক . সামছুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ঢাকার মতো ব্যস্ততম শহরে মেট্রোরেল নির্মাণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, নির্ধারিত সময়ে মাটির নিচে থাকা পরিষেবা স্থানান্তর করে ঠিকাদারদের প্রয়োজনীয় জায়গা বুঝিয়ে দেয়া। এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। পাইলিংয়ের কাজও অনেক দূর এগিয়েছে। সাধারণত ধরনের কাজে শুরুর দিকে যে ধরনের অগ্রগতি থাকে, শেষদিকে অগ্রগতি হয় তার চেয়ে বেশি। তবে সবকিছু নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের ওপর। একটি ঠিকাদারের কর্মতত্পরতা, অপরটি বাস্তবায়নকারী সংস্থার তদারকি। এসব ঠিকমতো হলে আমি মনে করি, ২০২১ সালেই মেট্রোরেল চালু করা সম্ভব।

মেট্রোরেল প্রকল্পের ঠিকাদারের তত্পরতা বাস্তবায়নকারী সংস্থার বর্তমান তদারকি কার্যক্রম জানতে চাইলে তিনি বলেন, উন্নত দেশে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা যে ধরনের মান বজায় রাখে, বাংলাদেশে তা হচ্ছে না। একইভাবে বাস্তবায়নকারী সংস্থার তদারকি কার্যক্রমও ঠিকমতো হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ পরিচালনার জন্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে সরকার। উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বণিক বার্তাকে বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাস্তবায়নের লক্ষ্য ২০২১ সালে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়েছে। সেই কর্মপরিকল্পনা ধরেই সব কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্যে ডিএমটিসিএল সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন