ব্যাংক সুদের হার

ব্যাংকিং খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টিতে বড় বাধা ‘কার্টেল’

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

[১ম পৃষ্ঠার পর]

অন্যদিকে বাকি প্রায় ৫৪ শতাংশ আমানত স্বল্পস্থায়ী ডিমান্ড ডিপোজিট তথা চলতি নগদ আমানত, সঞ্চয়ী আমানত, বিশেষ নোটিস অন্যান্য আমানতে এক্ষেত্রে সুদের হার শূন্য শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ধরনের আমানতে গড় সুদের হার শতাংশের কম বৈ বেশি হবে না। থেকে সহজেই হিসাব করা যায় যে, ব্যাংক আমানতে গড় সুদের হার দাঁড়ায় দশমিক ৮৮ শতাংশ (৪৬.১৫–.০৭+৫৩.৮৫–.০৩) এই কস্ট অব ফান্ডের বাস্তবতায় দশমিক ২৫ শতাংশ হারে স্প্রেড রেখে দশমিক শূন্য শতাংশ হারে ঋণ দিতে পারার কথা। গণখাত তথা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো কর্তৃপক্ষ মহলের পরামর্শ মেনে এক অংকের সুদ গুনেই ঋণ দিতে পারছে। বাস্তবতার খাতিরে যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার বেশি, সুষ্ঠু নীতি-কৌশল দক্ষ ব্যবস্থাপনা কুশলতায় তা কমিয়ে না আনা পর্যন্ত ঋণের সুদহার আরো শূন্য শতাংশ যুক্ত হয়ে শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে শূন্য শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্টে আর শূন্য শতাংশ সুদে খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল (নিয়মিতদের তুলনায়) বিশেষ সহজ শর্তে ১০ বছর মেয়াদি পরিশোধ ব্যবস্থার সিদ্ধান্তে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্য সংকট দেখা দিতে বাধ্য। আবার অনেক নিয়মিতভাবে ব্যাংকঋণের কিস্তি প্রদানকারীভালো ঋণগ্রহীতাঋণ খেলাপের রাস্তা নিচ্ছেন বলেও অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে।

ব্যাংকঋণে অন্য একটি গূঢ়ার্থ রয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে কলেবর আর মুনাফা দুই- বেড়ে চলেছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে খুব কমসংখ্যক ব্যাংক ফি বছর নিট মুনাফা অর্জন করত। তাও বছরে এক অংকের বেশি, অর্থাৎ ১০ কোটি কালেভদ্রে ছাড়াত। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে ২০০৯ সালে ৩০টি বেসরকারি মালিকানাধীন তফসিলি ব্যাংকের নিট মুনাফা ৫৪৯৮ দশমিক ১৯ কোটি টাকা (সর্বসাকল্যে সব ৪৮টি ব্যাংকে ১২০৭৭.২২ কোটি টাকা) হয়। আর ২০১৯ সালে ৪১টি বেসরকারি মালিকানাধীন তফসিলি ব্যাংকে নিট মুনাফা হয়েছে ১৪৯৪৪ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা (সর্বসাকল্যে ৫৯টি ব্যাংকের নিট মুনাফা হয়েছে ১৮২২৭.৬৩ কোটি টাকা) মোদ্দাকথা বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় নিট মুনাফা ক্রমবর্ধমান।

ব্যাংকঋণে সুদের খরচ মোট প্রকল্প খরচের কত অংশ, তা নিয়েও অনেকে ভেবে থাকেন। এটি নির্ভর করে প্রকল্পের পরিধি (সাইজ), প্রকৃতি, জেস্টেশন পিরিয়ড (খরচ শুরু থেকে রাজস্ব হাতে আসা পর্যন্ত সময়) ইত্যাকার বিষয়ের ওপর। প্রকল্প খরচের ঋণ: উদ্যোক্তা তহবিল অনুপাতের ওপরও ব্যাংকঋণে সুদের মোট খরচের অনুপাতকে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞ অভিজ্ঞজনরা মনে করেন, একটি পরিমিত পরিধির মোট প্রকল্প খরচে ব্যাংকঋণে সুদের খরচ এক-দশমাংশের বেশি নয়। বড়জোর অনুপাত ১২ শতাংশ হতে পারে। সুতরাং কথা বলাই যায় ব্যাংকঋণে সুদের বোঝাকে বাস্তবতার তুলনায় অনেক বড় করে দেখানো হচ্ছে।

কথা তাই অত্যন্ত স্পষ্ট যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যতই সমস্যা থাকুক না কেন, এর নিট মুনাফায় তাতে কোনো নেতিবচাক প্রভাব পড়েনি। ব্যাংকঋণে সুদের হার কমালে () শিল্পে বিনিয়োগ বেশি হতে পারে () আমানতে সুদের হার বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ (ডমেস্টিক) সঞ্চয়ের হার বেড়ে যায়, এটি অর্থনীতির জন্য অন্য রকম বিশাল কল্যাণ বয়ে আনে।

ব্যাংকঋণে সুদের হার বাড়ানো বা কমানো বা আমানতের সুদহার আর না কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশের সূচনা লগ্ন থেকেই অ্যাডমিনিস্টার্ড সুদ অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেয়া ব্যবস্থা ক্রমেই শিথিল হয়েছে। এখন কেবল কৃষিঋণে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সিলিং বেঁধে দিয়েছে। বাজার অর্থনীতিতে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে ব্যাংক সুদ বিষয়ে কোনো ভূমিকা পালন করে না। তবে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি, দক্ষতা বাড়ানো, বিনা বাধায় লোনেবল ফান্ড এবং তৎসম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান নিশ্চিত করে সুদের হারে তারতম্য আনতে পারে। কমাতে পারে দীর্ঘসূত্রতা এবংস্পিডমানি উপদ্রব। রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে সুদের হার এক অংকে নামিয়ে এনেছে এবং এদের আমানতে সুদের হার বরাবরই কম, শূন্য থেকে শূন্য শতাংশ। তাই ব্যাংকিং খাতে ৭৫-৮০ শতাংশের মালিকানায় যে বেসরকারি ব্যাংকিং খাত রয়েছে, তার ওপরই নির্ভরশীল ব্যাংক সুদের গতিপ্রকৃতি। এখানে ব্যবস্থাপনাও নাকি মালিকদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আর ব্যাংকিং খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় বাধা মালিকদেরকার্টেল সুতরাং বেসরকারি খাতের ব্যাংক মালিকরা সুদের হার অপরিবর্তিত রেখে অব্যাহতভাবে বেশি পরিচালন মুনাফা আয় করতে পারেন। তাতে সরকারের করপোরেট কর রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। সেক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সুবিধা বাড়াতে পারেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি তথা সেবার মান বাড়াতে পারেন। তাতে তাদেরই সিংহভাগ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানায় প্রবৃদ্ধি আসতে পারে। মোদ্দাকথা সার্বিকভাবে ব্যাংক সুদের নিয়ামক শক্তিই হচ্ছে বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলো তাদের মালিকরা।

 

. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ সমাজকর্মী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন