দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের সর্বোচ্চ গড় পরিচালন ব্যয় বা কস্ট অব ফান্ড (আমানতের সুদহার) পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের। ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অন্যদিকে মাত্র ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ কস্ট অব ফান্ড নিয়ে এদিক থেকে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড।
বাংলাদেশ
ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিদায়ী বছরের নভেম্বর শেষে দেশের ৪০টি বেসরকারি
ব্যাংকের মধ্যে ২৮টিরই কস্ট অব ফান্ড ছিল ৬ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে আমানতের গড়
সুদহার ৯ শতাংশের বেশি, এমন ব্যাংকের সংখ্যা তিনটি। ৮-৯ শতাংশ কস্ট অব
ফান্ড রয়েছে তিনটি ব্যাংকের। ১১ ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ৭ শতাংশের ঘরে। কস্ট
অব ফান্ড ৫ শতাংশের কম রয়েছে মাত্র চারটি বেসরকারি ব্যাংকের।
ব্যাংকঋণের
সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার কথা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। এজন্য আমানতের সুদহারও বেঁধে
দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে
সব ধরনের আমানতের সর্বোচ্চ সুদ বা কস্ট অব ফান্ড হবে ৬ শতাংশ। সাধারণত কস্ট অব
ফান্ডের সঙ্গে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ সুদ যুক্ত করে ঋণ বিতরণ করা হয়। অধিকাংশ দেশেই ঋণ
ও আমানতের সুদহারের এ ব্যবধান অনুসরণ করা হয়। এ অবস্থায় যেসব ব্যাংকের আমানতের গড়
সুদহার ৯ শতাংশের বেশি, সেগুলো ঠিক কত শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে পারবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।
পদ্মা ব্যাংক
ছাড়াও অন্য যে দুটি ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ৯ শতাংশের ওপরে, সেগুলো হচ্ছে এনআরবি গ্লোবাল ও ইউনিয়ন ব্যাংক। সরকারের
ঘোষণা অনুযায়ী, এ তিন ব্যাংককেও আগামী ১ এপ্রিল থেকে এক অংকের
সুদে ঋণ দিতে হবে। এর মধ্যে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক রয়েছে আমানতের গড় সুদহারের দিক
থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে। বিদায়ী বছরের নভেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানতের গড়
সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ। কস্ট অব ফান্ড কমানোর জন্য ব্যাংকটি বর্তমানে
দীর্ঘমেয়াদি আমানত সংগ্রহ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানালেন এনআরবি
গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাবিব হাসনাত।
বণিক বার্তাকে
তিনি বলেন, সরকার ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দিলে, আমরাও কম সুদে আমানত সংগ্রহ করব। এজন্য স্বল্পমেয়াদি আমানত
বাড়াতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি আমানতের সুদহার বেশি। তাই কস্ট অব ফান্ড কমাতে আমরা
দীর্ঘমেয়াদি আমানত সংগ্রহে কর্মীদের নিরুৎসাহিত করছি। তবে আমানতের গড় সুদহার
রাতারাতি কমানো সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্টদের
ভাষ্য অনুযায়ী, আগামী ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার সরকারি ঘোষণা
অনুযায়ী এক অংকে নামিয়ে আনা অনেক ব্যাংকের জন্যই দুষ্কর। কোনো একক ব্যক্তি বা
ব্যাংকের পক্ষে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। এতে এক ব্যাংকের
আমানত অন্য ব্যাংকে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার কস্ট অব ফান্ড বেশি থাকলে
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে পরিচালন লোকসান দিয়ে ঋণ বিতরণ করতে হবে। এতে বছর শেষে
সরকারের রাজস্ব সংগ্রহও কমবে।
কস্ট অব ফান্ডের
দিক থেকে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের অন্যতম মধুমতি ব্যাংক লিমিটেড। বিদায়ী বছরের
নভেম্বরে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ব্যাংকটি
গড়ে ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ
সুদে ঋণ দিয়েছে গ্রাহকদের।
এ অবস্থায় কস্ট অব ফান্ড ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনাকে বেশ দুরূহ বলে মনে করছেন
মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.
সফিউল আজম। তিনি বলেন, এরই মধ্যে তিন মাসের বেশি মেয়াদে যে আমানত আমরা সংগ্রহ
করেছি, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তার সুদ কমানো যাবে না। কারণ
গ্রাহকদের সঙ্গে করা চুক্তি ভঙ্গ হলে,
তা হবে আইনবিরুদ্ধ। কেউ
একক চিন্তা বা চেষ্টায় আমানতের সুদহার কমাতে পারবে না। এজন্য সব ব্যাংকের সম্মিলিত
উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় মেয়াদ শেষে এক ব্যাংকের আমানত বেশি সুদে অন্য ব্যাংকে
চলে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের নভেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর মধ্যে আমানতের গড় সুদ ৬ দশমিক ১৬ ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ৫ দশমিক ৭৯ ও বিদেশী ব্যাংকগুলো গড়ে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করেছে।
চতুর্থ
প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ড বেশি হলেও এ তালিকায় দেশের বেসরকারি খাতের
প্রথম সারির বেশ কয়েকটি ব্যাংকের নামও উঠে এসেছে। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি
ইসলামী ব্যাংকের আমানতের গড় মুনাফার হার ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। গড়ে ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ
সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড। এক্সিম ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক
লিমিটেডের কস্ট অব ফান্ড যথাক্রমে ৭ দশমিক ৭৮ ও ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। স্ট্যান্ডার্ড
ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ৭ দশমিক ৬৯,
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৭
দশমিক ৪৩, এবি ব্যাংকের ৭ দশমিক ৩৫, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৭ দশমিক শূন্য ৫, ঢাকা ব্যাংকের ৬ দশমিক ৯৭, মিউচুয়াল
ট্রাস্ট ব্যাংকের ৬ দশমিক ৮৩,
সাউথইস্ট ব্যাংকের ৬ দশমিক
৭৭, এনসিসি ব্যাংকের ৬ দশমিক ৬৯, ন্যাশনাল
ব্যাংকের ৬ দশমিক ৬২, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ৬ দশমিক ৩৫, যমুনা ব্যাংকের ৬ দশমিক ৩৫, প্রিমিয়ার
ব্যাংকের ৬ দশমিক ৩৪, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৬ দশমিক ২৫, দ্য সিটি ব্যাংকের ৬ দশমিক ১৪ ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৬
দশমিক ১২ শতাংশ।
বেসরকারি
ব্যাংকগুলোর মধ্যে গড়ে সবচেয়ে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক
লিমিটেড। ব্যাংকটির কস্ট অব ফান্ড মাত্র ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সর্বনিম্ন সুদে আমানত
সংগ্রহ করলেও গড়ে ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। দেশের
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮ দশমিক ৪ শতাংশ স্প্রেড ব্যাংকটির। যদিও
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী,
সব ব্যাংকের স্প্রেড ৪
শতাংশের মধ্যে থাকার কথা।
কস্ট অব ফান্ড
মাত্র ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের। যদিও লুণ্ঠনের শিকার এ
বেসরকারি ব্যাংকটিতে নতুন কোনো আমানত রাখছেন না গ্রাহক। ৮০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ
নিয়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছে ব্যাংকটি।
রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে লুণ্ঠনের শিকার বেসিক
ব্যাংক লিমিটেড। গত নভেম্বর শেষে এ ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ছিল ৬ দশমিক ২২
শতাংশ। এছাড়া বিডিবিএলের গড় সুদহার ৫ দশমিক ২৭, জনতা ব্যাংকের ৪
দশমিক ৫৮, রূপালী ব্যাংকের ৪ দশমিক ৫৫, অগ্রণী ব্যাংকের ৪ দশমিক ৩৮ এবং সোনালী ব্যাংকের আমানতের গড়
সুদহার ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
ঋণ ও আমানতের
সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড)
হিসাবায়নের ক্ষেত্রে
ব্যাংকগুলো সাধারণত বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে। এতে করে ব্যাংকগুলোর
আমানত ও ঋণের সুদহারের গড় হিসাবায়নে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টিকে অভিন্ন
প্রক্রিয়ার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য স্প্রেড হিসাবায়নের
জন্য একটি নীতিমালা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারির কথা রয়েছে।
কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান,
আমানতের সুদের সঙ্গে
প্রশাসনিক ব্যয় যুক্ত করে স্প্রেড হিসাবায়ন করা হয়। একইভাবে ঋণের সুদের সঙ্গে
প্রশাসনিক ব্যয় যুক্ত করে গড় সুদহার বের করে থাকে ব্যাংকগুলো। এ হিসাবায়নের
ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ বেশি, এমন ব্যাংকগুলো অস্বচ্ছতার আশ্রয় নেয়। ফলে ওই
ব্যাংকগুলোর প্রকৃত স্প্রেডের হিসাব পাওয়া যায় না। এছাড়া ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের
প্রক্রিয়া ব্যবহার করে স্প্রেড হিসাব করায় অসামঞ্জস্য তৈরি হয়। বিষয়টিকে একটি
সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার আওতায় আনার জন্যই নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। চলতি মাসেই এ-সংক্রান্ত নীতিমালা জারির সম্ভাবনা রয়েছে।