নৌপথের সম্ভাবনায় শঙ্কা বাড়াচ্ছে রেলসেতুর উচ্চতা

জেসমিন মলি ও শামীম রাহমান

টঙ্গীতে তুরাগ নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নির্মাণাধীন সেতুটির উচ্চতা পানির স্তর থেকে বেশ কম। ফলে কমে এসেছে সেতুর তলদেশ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ। শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) যদিও বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত রেলওয়ের সঙ্গে পেরে ওঠেনি সংস্থাটি। আপত্তির মুখে নির্মাণাধীন রেলসেতুটির উচ্চতা কিছুটা বাড়ানো হলেও সেটি নৌচলাচলের জন্য পুরোপুরি উপযোগী হবে না বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা। ফলে ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার নৌপথের সম্ভাবনাও অনেকটা কমে এসেছে।

একই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়ার শঙ্কা রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে রেলপথটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। নির্মিতব্য রেলপথটির ১৩ সেতুর মধ্যে ১১টির উচ্চতা নৌযান চলাচলের উপযোগী রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু এক্ষেত্রেও পরিকল্পনা থেকে সরতে চাইছেন না রেল কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে তাদের ভাষ্য, বিআইডব্লিউটিএর পরামর্শ মেনে সেতুর উচ্চতা বাড়ানো হলে তাতে প্রকল্পের ব্যয় আরো বাড়বে।

তবে বিষয়টি নিয়ে এখনো কথা বলার সময় আসেনি বলে মনে করছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের কেবল সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলছে। এটি আগে শেষ হোক। এরপর নকশা করা হবে। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) প্রস্তুত করা হবে। একনেকে অনুমোদন করা হবে। এগুলো অনেক সময়সাপেক্ষ। আগে আমরা প্রাথমিক কাজগুলো শেষ করি। যদি এ প্রকল্পের সেতুগুলোর উচ্চতা বাড়ানোর দরকার হয়, তাহলে সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মিতব্য রেলপথটিতে সেতুর উচ্চতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষের উচিত বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সমন্বয় করে নেয়া। অন্যথায় এক্ষেত্রেও টঙ্গীতে নির্মীয়মাণ তুরাগের রেলসেতুটির ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে। বিআইডব্লিউটিএর আপত্তির মুখে রেলসেতুটির উচ্চতা কিছুটা বাড়ানো হলেও তা সব ধরনের নৌযান চলাচলের জন্য উপযোগী নয় বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম।

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এখন যে নকশায় টঙ্গীর রেলসেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে হয়তো বালিবাহী বাল্কহেডসহ কিছু ছোট ছোট নৌযান চলতে পারবে। কিন্তু জাহাজ বা তুলনামূলক বড় নৌযান এ নৌপথ দিয়ে চলতে পারবে না।

পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পরিদর্শন প্রতিবেদন সূত্রে নৌ ও রেল চলাচল কর্তৃপক্ষের মধ্যকার এ অস্বস্তির বিষয়টি জানা গেছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়কনির্ভরতা কাটাতে রেলপথ ও নৌপথের উন্নয়ন ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই উন্নয়ন পরিকল্পনা সড়ক, রেল ও নৌপথের সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো একটি সংস্থা বা বিভাগের উন্নয়নের কারণে অন্য কোনো সংস্থা বা বিভাগের পরিকল্পনা কিংবা সম্ভাবনা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ রেলওয়েতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়কের মতো চাইলেই রেলসেতুর উচ্চতা যেকোনো জায়গায় বাড়ানো যায় না। বিআইডব্লিউটিএ যে উচ্চতায় টঙ্গীর রেলসেতুটি নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিল, তাতে দুই পাশে অন্তত ছয় কিলোমিটার রেলপথ উঁচু করে নির্মাণের প্রয়োজন। এটি করতে হলে ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন ও টঙ্গী স্টেশনের অবকাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হতো। কিন্তু এ প্রক্রিয়া একই সঙ্গে সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে বিআইডব্লিউটিএর পরামর্শমাফিক উচ্চতায় সেতুটি নির্মাণ করতে পারছে না রেলওয়ে।

কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার প্রকল্পের অধীন সেতু ও রেলপথ এখনো পরিকল্পনার পর্যায়েই রয়েছে। ফলে প্রকল্পটিতে এ সমস্যা সমাধানের এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকাকে জরুরি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে রেল, সড়ক, নৌ সমান গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর কোনো একটির উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে যদি আরেকটি ক্ষতিগ্রস্ত বা কোনো সম্ভাবনা নষ্ট হয়, তাহলে বিষয়টি অবশ্যই শঙ্কার। সব সমস্যারই ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশন আছে। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত নিজেদের মধ্যে বিরোধে না জড়িয়ে সমন্বয় করে সবচেয়ে ভালো সমাধানে যাওয়া।

একই কথা বললেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলামও। তিনি বলেন, নৌ, রেল ও সড়কপথঅভ্যন্তরীণ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে তিনটিরই গুরুত্ব সমান। তাই ভবিষ্যতে উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার স্বার্থেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয় করে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই।

নির্মিতব্য ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের সেতুগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, নৌচলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন কোনো অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন বিআইডব্লিউটিএ দেবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন