শিক্ষা খাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে ২০১২ সালে একটি মহাপরিকল্পনা নেয় সরকার। ‘ভিশন ২০২১’
সামনে রেখে নেয়া এ মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন অগ্রগতি গত বছর পর্যালোচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনাগুলোর মাত্র ৩১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। এ হিসাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম এ মাস্টারপ্ল্যানের ৬৯ শতাংশই এখনো অবাস্তবায়িত।
‘মাস্টার প্ল্যান ফর আইসিটি ইন এডুকেশন ইন বাংলাদেশ (২০১২-২১)—প্রগ্রেসিভ রিভিউ রিপোর্ট ২০১৯’
শীর্ষক প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহাপরিকল্পনার মূল খাতগুলোকে প্রাথমিক, উপানুষ্ঠানিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, আইসিটি, উচ্চশিক্ষা, শিক্ষা প্রশাসন—এ আট ভাগে ভাগ করা হয়। এসব খাতে সর্বমোট ১৬২টি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রতিবেদনে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নের হারের ভিত্তিতে পরিকল্পনাগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলোকে সবুজ, বাস্তবায়নাধীন বিষয়গুলোকে হলুদ এবং এখনো বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরুই হয়নি সেসব পরিকল্পনা লাল শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনে সর্বমোট ১৬২টি পরিকল্পনার মধ্যে ৫০টি সবুজ, ৩৬টি হলুদ ও ৭৬টি লাল শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। সে হিসাবে ১০ বছরের মহাপরিকল্পনার মাত্র ৩১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে গত সাত বছরে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা খাতে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জোর দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল সময়োপযোগী জনবল তৈরি। এর অংশ হিসেবে পাঠ্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তিকে খুবই গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও সে অনুযায়ী শিক্ষা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ঘটেনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সারা বিশ্বেই তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ঘটছে। বিশেষ করে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ছোঁয়া। এমন অবস্থায় দেশের বর্তমান প্রজন্মকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তিবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি প্রযুক্তির ছোঁয়া না থাকে, তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শিখবে কীভাবে? তাই আমি মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনে প্রযুক্তির ব্যবহার আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনে এ খাতে বরাদ্দও বাড়াতে হবে।’
পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে পিছিয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। এ খাতে তিন ক্যাটাগরিতে নেয়া ১৪টি পরিকল্পনার কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। পাঁচটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন ও নয়টি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি।
আইসিটি প্রসারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পিছিয়ে রয়েছে মাদ্রাসাও। এ খাতে চার ক্যাটাগরিতে নেয়া ১৯টি পরিকল্পনার মধ্যে সবুজ তালিকায় রয়েছে মাত্র তিনটি। এ হিসেবে মাদ্রাসায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে নেয়া পরিকল্পনাগুলোর গত সাত বছরে বাস্তবায়নের হার মাত্র ১৬ শতাংশ। আর বাস্তবায়নাধীন (হলুদ) পাঁচটি ও লাল শ্রেণীভুক্ত রয়েছে ১১টি পরিকল্পনা।
অন্য খাতগুলোর মধ্যেও বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২৩টি পরিকল্পনার মধ্যে আটটি সবুজ, ছয়টি হলুদ ও ৯টি লাল; মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৩৪টি পরিকল্পনার মধ্যে ১১টি সবুজ, নয়টি হলুদ ও ১৪টি লাল; আইসিটিতে ২৭টি পরিকল্পনার মধ্যে ১১টি সবুজ, ছয়টি হলুদ ও ১০টি লাল; উচ্চশিক্ষায় ১৬টি পরিকল্পনার মধ্যে ছয়টি সবুজ, দুটি হলুদ ও আটটি লাল এবং শিক্ষা প্রশাসনে ২৯টি পরিকল্পনার মধ্যে ১১টি সবুজ, তিনটি হলুদ ও ১৫টি পরিকল্পনা লাল শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তির যন্ত্র স্থাপনের মতো অবকাঠামো নেই। বিশেষ করে গ্রাম ও উপকূলের অনেক বিদ্যালয়ের নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক যন্ত্রপাতি স্থাপন সম্ভব হয় না। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সচেতনতার অভাবকে আরেকটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বড় অংশই এখনো ডিজিটাল কনটেন্ট ও পোর্টালসহ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারছেন না। এছাড়া ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকা, নিয়মিত মেইনটেন্যান্স না হওয়া ও মনিটরিংয়ের অভাবকে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার না হলে আমাদের জনগোষ্ঠী এর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে। তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত না হলে চাকরির বাজারেও ভালো করবে না তারা। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এখনো বিদেশ থেকে লোক এনে কাজ করাতে হয়। তাই আমাদের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত। পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পর সেটি বাস্তবায়ন না হলে তো কোনো লাভ নেই। তাই শুধু পরিকল্পনা নয়; সেটি বাস্তবায়নের হারও সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকতে হবে।