গত বছরের জানুয়ারিতে মারা গেছেন ইনডেক্স ইনভেস্টিংয়ের জনক জন সি বোগল। তাকে উত্সর্গ করে গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি সম্মেলন। তথাকথিত বাজার বিশ্লেষকদের কেউ এ সম্মেলনের আয়োজন করেননি। তিন দিনব্যাপী এ বৈঠকের আয়োজক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা। এতে যোগদান করেন ২০০ জন বিনিয়োগকারী, যাদের কেউই বাজার বিশ্লেষক বা পুঁজিবাজার থেকে রাতারাতি ধনী হওয়া বিখ্যাত কেউ নন। ডাক্তার, প্রকৌশলী, ওয়েব ডেভেলপার, গাড়িচালনা প্রশিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ এতে যোগদান করেন। তবে সবার মধ্যে ছিল বিস্তৃত বিনিয়োগের প্রতি দীর্ঘকালীন প্রতিশ্রুতি। মূলত স্বল্পমূল্যের ইনডেক্স মিউচুয়াল ফান্ড ছিল সম্মেলনটির আলোচনার কেন্দ্রে। নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশকিছু পরামর্শও দিয়েছেন অপেক্ষাকৃত অপরিচিত এসব ঝানু বিনিয়োগকারী।
যেসব বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে
জন বোগলের বিনিয়োগ কৌশল অনুসরণ করেন তাদের বোগলহেড বলা হয়। বোগলের অনুসারীরা হলেন
ঠাণ্ডা মাথার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী। স্বল্পমেয়াদে পুঁজিবাজার থেকে ধনী হওয়া
এদের উদ্দেশ্য নয়। বোগলহেড বিনিয়োগকারীরা সবসময় স্বল্পমূল্যের ইনডেক্স মিউচুয়াল
ফান্ড ও এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে
(ইটিএফ)
বিনিয়োগকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। দ্রুত কিছু
করে ফেলার চেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়াই এ বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য। লেগে থাকাই
তাদের বিনিয়োগ কৌশলের মূল বিশ্বাসের জায়গা।
১৯৭৫ সালে জন বোগল প্রতিষ্ঠা করেন নিজের
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ভ্যানগার্ড। ভ্যানগার্ডকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে
একটি অনলাইন কমিউনিটি, যার নাম ছিল ‘ভ্যানগার্ড ডাইহার্ডস’। এ গ্রুপটির উদ্যোগেই দুই দশক ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বোগলহেডস কনফারেন্স।
জন সি বোগল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট মেল লিনডোয়ার বলেন, জন বোগল প্রায়
প্রতি বছরই এ সম্মেলনে সাগ্রহে যোগদান করতেন এবং বিনিয়োগ বিষয়ে সবার বক্তব্য মন
দিয়ে শুনতেন। এ বছরই প্রথম তাকে ছাড়া অনুষ্ঠিত হলো সম্মেলনটি। আগের সম্মেলনগুলোর
সঙ্গে গত বছরের সম্মেলনের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো বোগলের অনুপস্থিতি।
এবারের সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
অংশ হলো নতুন বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে দেয়া অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের কিছু পরামর্শ।
বোগলের বিনিয়োগ কৌশলের আলোকেই এসব পরামর্শ দিয়েছেন তারা—
নিখুঁত হওয়ার পরিবর্তে কম বয়সে নেমে
পড়ুন
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবাই নিখুঁত হওয়ার
সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে থাকেন। নতুন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি
দেখা যায়। বিনিয়োগে নামার আগে তারা নিজেদের ধারণাগুলোকে ভালোভাবে ঝালিয়ে নিয়ে চায়।
মুনাফা করার জন্য যে কেউ সবচেয়ে উত্কৃষ্ট পদক্ষেপটি নিতে চাইবে—এটিই
স্বাভাবিক। কিন্তু বোগলহেড কনফারেন্সে যোগ দেয়া বিনিয়োগকারীরা বলছেন, খুব বেশি
চিন্তা না করে দ্রুত বিনিয়োগে নেমে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। খুব বেশি অপশন দ্বারা
আবিষ্ট হওয়া যাবে না। নিজেকে অবশ্যই ডিসিশন প্যারালাইসিস থেকে রক্ষা করতে হবে।
যদিও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার মাধ্যমে পরিকল্পনা করা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ, তার পরও ছোট বিনিয়োগে হলেও দ্রুত নেমে পড়াই উত্তম।
বিনিয়োগে নেমে পড়লেই একজন বিনিয়োগকারী
দ্রুত মুনাফা করা শুরু করেন। সুদ যেমন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে, তেমনি সঠিক
শেয়ারে বিনিয়োগ করলে মুনাফাও চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফা
বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে অভিহিত
করেছিলেন। যত দ্রুত একজন বিনিয়োগকারী আয় করা শুরু করেন, তার আয়ও তত
দ্রুত বাড়তে থাকে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে গিয়ে সম্মেলনে বিনিয়োগকারীরা বলেন, যেসব
বিনিয়োগকারী বিশের কোটায় থাকা অবস্থাতেই অল্প অল্প করে বিনিয়োগ করা শুরু করেছেন, তারা বেশি বয়সী
বড় বিনিয়োগকারীদের চেয়ে বেশি মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছেন।
একটি নির্দিষ্ট শেয়ারকেন্দ্রিক হওয়া
থেকে বিরত থাকুন
যদি কেউ মনে করে থাকেন যে বিনিয়োগ
মানে হলো সর্বোত্তম শেয়ারটি বাছাই করে নেয়া,
তবে তার ধারণা নিশ্চয়ই ভুল নয়। এটিও বিনিয়োগের
একটি ধরন। একটি শেয়ার কেনা অনেকটি বাজি ধরার মতো ব্যাপার। দিনভর বাজারের উত্থান-পতনের সঙ্গে
সঙ্গে শেয়ারটির দরও ওঠানামা করবে। কিন্তু বোগলহেড বিনিয়োগকারীরা প্যাসিভলি-ম্যানেজড
ইনডেক্স ফান্ডে বিনিয়োগকেই নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য সর্বোত্তম বিনিয়োগ কৌশল মনে
করেন। এ ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো একটি নির্দিষ্ট শেয়ারের দর ওঠানামা করলেও
একজন বিনিয়োগকারীর খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। একটি শেয়ারের দর
কমলেও অন্য একটি শেয়ার দিয়ে তা হয়তো পুষিয়ে যায়।
প্যাসিভলি-ম্যানেজড
ফান্ডে বিনিয়োগ হলো বোগলের বিনিয়োগ কৌশলের অন্যতম একটি স্তম্ভ। বিভিন্ন গবেষণায়ও
এর যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অ্যাক্টিভলি-ম্যানেজড
ফান্ডগুলোর বেশির ভাগই গত প্রায় এক দশকে প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারেনি।
শেয়ার কেনার পর স্থির থাকুন
বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই সাধারণত তার
শেয়ারগুলো কেমন করছে, প্রতিনিয়ত তার খোঁজ করতে থাকেন। বিনিয়োগ করার পরমুহূর্ত থেকেই অনেকে
এটি করা শুরু করেন। এতে কি আদতে কোনো লাভ হয়?
বোগলহেড বিনিয়োগকারীদের মতে, এতে আসলেই কোনো
লাভ নেই। গত বছরের বোগলহেড কনফারেন্সে যে প্রশ্নগুলো সবচেয়ে বেশি উঠেছে, তা হলো ‘আপনি কি
বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারদরের ওঠানামা লক্ষ করা শুরু করেন? আপনি জানেন যে
আপনি শেয়ারটি অন্তত এক বছর ধরে রাখবেন,
তার পরও কি আপনার মধ্যে প্রতিনিয়ত শেয়ারদর দেখার
বাতিক কাজ করে?’
বোগলহেড বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়ে বলেন, যদি আপনি
নিশ্চিত থাকেন যে আপনি এক বছরের জন্য বিনিয়োগ করছেন, তাহলে বিনিয়োগ করার পর এ নিয়ে চিন্তা
করা ছেড়ে দিন। বাজারকেই আপনার শেয়ারের ভাগ্য নির্ধারণ করতে দিন।
মানি ডটকম অবলম্বনে