দুর্বল আর্থিক খাত

আত্মঘাতী ব্যাংকিং

হাছান আদনান

বিদায়ী বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত ছিল প্রায় ১১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই বছরের বেশি মেয়াদি আমানত ছিল ৭ শতাংশের কম। অথচ দেশের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ৮০ শতাংশের মেয়াদই দুই বছরের বেশি। এভাবেই স্বল্প মেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে ব্যাংকগুলো। যদিও সময়মতো ফেরত আসছে না ঋণের অর্থ, বেড়ে চলেছে নন-পারফর্মিং ঋণ। ব্যাংকগুলোর এমন আত্মঘাতী ব্যাংকিং দেশের পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাকে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে বড় হচ্ছে না আর্থিক খাত।  পুঁজিবাজার বিধ্বস্ত, করপোরেট বন্ড বাজারের সূচনাই হয়নি। কমার্শিয়াল পেপার বা অন্য কোনো উপকরণও নেই মানি মার্কেটে। ফলে প্রায় সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের একটি অর্থনীতি নির্ভর করে আছে পুরোপুরি ব্যাংকিং খাতের উপরে। কিন্তু অবাধ লুণ্ঠন আর খেলাপি ঋণের ভারে বিপর্যস্ত খাতটি।

দেশে আমদানি বা রফতানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুললে সে দায় সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে ঋণপত্রের দায় ফোর্স লোনে রূপান্তর হচ্ছে। শিল্পে চলতি মূলধন দিলে সেটিও যথাসময়ে ফেরত আসছে না। মেয়াদি ঋণসহ সব ধরনের ঋণই খেলাপি হলে ১৫ বছরের জন্য তা পুনর্গঠন হচ্ছে। পুনর্গঠিত ঋণও পুনঃতফসিল হচ্ছে ১০ বছরের বেশি সময়ের জন্য। গাড়ি বা বাড়ি কেনার মতো রিটেইল ঋণের মেয়াদও ৩ থেকে ১৫ বছর। অথচ ব্যাংকগুলো আমানতের মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশের মেয়াদ দুই বছরের বেশি। সম্পদ ও দায়ের মেয়াদের মধ্যে এ অসামঞ্জস্যতাকে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ধরনের মিসম্যাচ হিসেবে দেখছেন ব্যাংকাররা।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তিন মাস মেয়াদি আমানত থেকে ১০ বছরের জন্য ঋণ দেয়া হচ্ছে। সে ঋণও যথাসময়ে ফেরত আসছে না। ১৫ বছরের জন্য পুনর্গঠনকৃত খেলাপি ঋণ আবারো পুনঃতফসিল করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য কখনই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া এ ব্যাংকার বলেন, অ্যাসেট লায়াবিলিটি ম্যানেজমেন্টের (এএলএম) ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাকে কমপ্লিটলি মিসম্যাচ বলা যায়। দেশের অর্থনীতি উন্নত হচ্ছে। এজন্য ব্যাংকগুলো আগের মতো চললে হবে না। পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি করতে হবে। এএলএমে যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে যোগ্যদের এনে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিট শক্তিশালী করতে হবে। অন্যথায় ঝড় শুরু হলে কেউ টিকবে না।

দেশের ব্যাংকিং খাতের হালনাগাদ তথ্য দিয়ে প্রতি তিন মাস পরপর ‘শিডিউলড ব্যাংক স্ট্যাটিস্টিকস’ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রকাশনাটির ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন সংখ্যার তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ৩০ জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত ছিল ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। মোট ১০ কোটি ৩ লাখ ৩৭ হাজার ব্যাংক হিসাবে এ আমানত জমা রেখেছেন গ্রাহকরা। সর্বোচ্চ ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ অর্থ মেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) হিসেবে জমা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৭৭ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকার আমানতের মেয়াদ ছিল দুই বছরের বেশি। এ ধরনের আমানতের বিপরীতে গ্রাহকদের সবচেয়ে বেশি সুদ দিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে থাকা অর্থের মধ্যে ছয় মাসের কম মেয়াদের আমানত রয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ। ছয় মাসের বেশি কিন্তু এক বছরের কম মেয়াদি আমানত রয়েছে ৮৩ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। এক থেকে দুই বছর মেয়াদি আমানত ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। এটি দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি আমানত রয়েছে ৯ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। এছাড়া তিন বছর থেকে বেশি মেয়াদি আমানত ছিল ৬৮ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। এটি দেশের মোট আমানতের ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

মেয়াদি আমানত ছাড়াও দেশের ব্যাংকগুলোতে চলতি ও নগদ হিসাবে আমানত জমা রয়েছে ৯৩ হাজার ৮৩ কোটি টাকা, এটি মোট আমানতের ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। সঞ্চয়ী হিসাবে আমানত জমা রয়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ২০ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। বিশেষ নোটিসের আমানত বা এসএনডি হিসাবে জমা রয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। এসব ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো গ্রাহককে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করে।

কোনো ব্যাংক থেকেই একই সঙ্গে সব গ্রাহক আমানতের টাকা তুলে নেন না। এজন্য ব্যাংকের চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবে থাকা আমানত, মেয়াদি (ফিক্সড ডিপোজিট) আমানতসহ বিভিন্ন ধরনের আমানতকে হিসাবায়ন করে ‘কোর ডিপোজিট’ বের করে ব্যাংকগুলো। দেশের ব্যাংকগুলোর কোর ডিপোজিটের হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতিটি ব্যাংক মনে করে, তার কাছে থাকা আমানতের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ অর্থ গ্রাহকরা যখন-তখন ফেরত চাইবেন না। যদিও দেশের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের প্রায় ৮০ শতাংশ দুই বছরের বেশি মেয়াদের।

স্বল্পমেয়াদি আমানত দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ব্যাংকের জন্য সব সময়ই ঝুঁকির মনে করেন সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে সব সময়ই কিছু না কিছু আমানত আসে, এজন্য বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করা যায় না। আমরা প্রতিনিয়ত পাঁচ-সাত বছর মেয়াদি বিনিয়োগ করছি। কিন্তু কোনো ব্যাংকই এ মেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে না। স্বল্পমেয়াদি আমানত দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সব সময়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তার পরও আমরা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছি।

এ ব্যাংকারের মতে, দেশের পুঁজিবাজার বিপর্যস্ত। বন্ড মার্কেট এখনো যাত্রাই করেনি। মানি মার্কেটের অন্য কোনো উপকরণও দেশে নেই। ফলে প্রায় সাড়ে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের একটি অর্থনীতি পুরোপুরি ব্যাংকনির্ভর। দেশের ব্যাংকগুলোর কোর ডিপোজিট ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হলেও ঋণের ৭০ শতাংশই দীর্ঘমেয়াদের। ব্যাংকঋণের সুদহারে স্থিতিশীলতা না আসার এটিও বড় কারণ।

গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করাই যেকোনো ব্যাংকের মৌলিক কাজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত দেশের সবক’টি তফসিলি ব্যাংক সরকারি-বেসরকারি খাতে মোট ৯ লাখ ৫১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকাই বেসরকারি খাতে বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ৪০ দশমিক ৭৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে শিল্প খাতে। এর মধ্যে সব ধরনের শিল্পে মেয়াদি ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে ২০ দশমিক ১১ শতাংশ। চলতি মূলধন হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে শিল্পে মোট ঋণের ২০ দশমিক ৬৩ শতাংশ ।

পৃথিবীর কোনো দেশেই শুধু ব্যাংকঋণের ওপর ভিত্তি করে শিল্পায়ন দাঁড়ায়নি বলে মন্তব্য করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তার মতে, আমাদের পুঁজিবাজার স্থিতিশীল নয়। অর্থসংস্থানের জন্য উদ্যোক্তাদের অন্য কোনো পথও খোলা নেই। এজন্যই ছোট-বড় সব ধরনের উদ্যোক্তারা ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভর করেন। স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার গঠিত কমিটির সদস্য হিসেবে আমি ব্যাংকঋণের সুদহার কমানোর পক্ষে। ঋণের সুদহার কমে গেলে ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে নিরুৎসাহিত হবেন। এতে বাধ্য হয়ে উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারে যাবেন। বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি জোগানে উৎসাহিত হবেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কোথায়ও বিনিয়োগের জায়গা না থাকায় আমানতকারীরাও কম সুদে ব্যাংকে টাকা রাখতে বাধ্য হবেন।

মোট ব্যাংকঋণের ৩৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে। এছাড়া ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ নির্মাণ খাতে, ৭ দশমিক ২১ শতাংশ ভোক্তা ঋণে, ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ কৃষি খাতে, ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ অন্যান্য শিল্প খাতে, শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ ঋণ ট্রান্সপোর্টে বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।

দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশই নাম লিখিয়েছে খেলাপির খাতায়। পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবে ধরলে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশই বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্ত। বিপুলসংখ্যক খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা।

এছাড়া ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে সম্প্রতি আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশে বেঁধে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগেও কয়েক দফায় আমানত ও ঋণের সুদহার নয়ছয় হবে বলে সরকার ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছিল। যদিও সে ঘোষণার বাস্তবায়ন কখনই দেখা যায়নি। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ এপ্রিল থেকে সব ধরনের আমানতের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। ব্যাংক আমানত ও ঋণের সুদহার নিয়ে চাপাচাপিতে দুই বছরের বেশি মেয়াদি আমানত আরো কমবে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এ নির্বাহী পরিচালকের মতে, এমনিতেই ব্যাংকিং খাতে সম্পদ ও দায়ের মধ্যে বড় ধরনের মিসম্যাচ আছে। এ অবস্থায় আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতির আরো বিপর্যয় হবে। গ্রাহকরা ৬ শতাংশ সুদে ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি আমানত কেন রাখবে? যেসব গ্রাহক এখন মেয়াদি আমানত রেখেছেন, সেগুলোও তুলে নিতে চাইবেন। ব্যাংকগুলোও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহে লাগাম টানবে। বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে অর্থনীতির অন্যান্য শাখা-প্রশাখাও বিপর্যয়ে পড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন