মেঘে ঢাকা ফুরমোন পাহাড়ে...

পাহাড়ের ওপরে বসে মেঘ পাহাড়ের মিতালি দেখতে কে না চায়! মিতালি দেখতে প্রতি বছরের এমন শীতের দিনে হাজারো মানুষ ঘুরে বেড়ায় দূর পাহাড়ে। কেউবা বান্দরবানের নীলগিরি, কেউবা রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালিতে। তবে রাঙ্গামাটি শহরের অদূরের একটি পাহাড়ের চূড়ায়ও এমন মিতালির দেখা মেলে। সেটি হলো ফুরমোন পাহাড়। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের মাঝপথের সাপছড়ি এলাকা দিয়ে পাহাড়টিতে যাওয়া যায়।

রাঙ্গামাটি শহর থেকে দীর্ঘদিন পাহাড়টির চূড়া দেখে দেখেই সমুদ্রসম ভালোবাসা জমে গেছে ফুরমোনের প্রতি। ভালোবাসার পরিমাণ ফুরমোনের উচ্চতার কম নয়। হঠাৎ একদিন কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম শীতে ফুরমোন দেখে আসা যাক। দিনটি ছিল ২৫ ডিসেম্বর। ফুরমোন পাহাড়ে যাব বলে আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল বেশ। ২৫ ডিসেম্বর ভোরের দিকে একে একে ভ্রমণ টিমের সবাই জড়ো হলাম রাঙ্গামাটি শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপায়। বাস ছাড়ল সাড়ে ৭টায়। আধা ঘণ্টা পরই রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের সাপছড়ি ফুরমোন পাহাড়ের পাদদেশে নামলাম।

বাস থেকে নামার পরই নানা ধরনের অনুভূতি কাজ করছিল। শহর থেকে এতদিন যে পাহাড়চূড়া দেখে এসেছি, আজ তাকে জয় করব। ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা মিনিটি। একে তো শীতকাল, তার ওপর বইছে শৈত্য! কনকনে শীত উপেক্ষা করে আধা ঘণ্টা হেঁটে সবাই ঘামিয়ে গেলাম। আমরা ছিলাম ১৪ জনের ভ্রমণ দল। আশপাশে আরো কয়েকটি দল ট্রেকিং করছিল। পাহাড়ের রাস্তায় তখন কুয়াশা মেঘের কারণে অন্য দলগুলোকে পরিষ্কার দেখতেও পাচ্ছিলাম না। তখনই বুঝতে পারলাম আমরাও মাঝেমধ্যে মেঘের ভেতরে ঢুকে পড়েছি! টানা প্রায় ঘণ্টা হাঁটার পর সবাই বেশ ক্লান্ত। এছাড়া অনেকে সকালের নাশতা সারেনি। বিশ্রাম নিতে নিতে সবাই যার যার ব্যাগে থাকা নাশতা সেরে নিল।


এবার সিদ্ধান্ত পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার আগ পর্যন্ত বিশ্রাম নয়। আরো ঘণ্টা হাঁটার পর চূড়ার কাছে পৌঁছে গেলাম। সেখানে রয়েছে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। সেখানেই চা নৃগোষ্ঠীদের বিভিন্ন ধরনের পিঠা খেলাম। এরপর সবাই মিলে চললাম একটু নিচের পথে, ফুরমোন ভাবনা কেন্দ্রের বেইন ঘরের দিকে। বেইন ঘরের পথটি পুরোটাই মাটির। বেইন এলাকায় পৌঁছে মুগ্ধ হলাম। বেইন ঘরের ছাদ থেকে আশপাশের এলাকা যে কতটা সুন্দর! ফুরমোন না এলে মনে হয় অপূর্ণই থেকে যেতে। এরপর সবাই প্রকৃতির সঙ্গে নিজের স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা। দলগত ছবি, একাকী ছবি তোলার পর বেইন ঘর এলাকা ত্যাগ। ফের এসে পৌঁছলাম সেই চায়ের দোকানে। মাটির উঁচু রাস্তার কারণে পথ হেঁটেই একেবারে সবাই বেশ ক্লান্ত। ১০ মিনিট বিশ্রাম, ফের গন্তব্য ফুরমোন চূড়া। এবার আর মাটি কিংবা সলিং রাস্তা নেই। চূড়া পর্যন্ত বিশাল সিঁড়ি। অনেকেই সিঁড়িকেস্বর্গ সিড়িবলে থাকে। সিঁড়ির ধাপ হাজার খানেকের কম না। সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠেই দলের একজন বলে উঠল যেন স্বর্গে পৌঁছালাম। চারদিক দেখে সবাই মুগ্ধ। ঘড়ির কাঁটায় হিসাবে কষে দেখলাম পুরো পাহাড়ে হেঁটে উঠতে সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টার মতো। চূড়া থেকে পুরো রাঙ্গামাটি শহর দেখা যাচ্ছে। বিশাল দালান-কোটা দেখে মনে হচ্ছে ক্ষুদ্র বিন্দু। ফুরমোন চূড়ায় রয়েছে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। অনেকেই সেখানে আরাধনা করছেন।


ফুরমোন পাহাড়ে খানিকক্ষণ কাটানোর পর চলে গেলাম পাশের সেনাবাহিনী ক্যাম্পের হেলিপ্যাডে। তখন সূর্য একদম মাথার ওপর। হেলিপ্যাড থেকে অন্য পথ দিয়ে নামার পথ আছে। বলে রাখি, আমাদের ট্রেকিংয়ের উদ্দেশ্যই ছিল এক পথে উঠব, আরেক পথে নামব। হেলিপ্যাডে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। যেহেতু ফুরমোনে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা নেই, তাই আমরা সঙ্গে করে সকালের নাশতা দুপুরের খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। খাবার খেয়ে সবাই হেলিপ্যাডে ঘুরে বেড়ালাম। হেলিপ্যাড থেকে আরো সুন্দর মুগ্ধকর রাঙ্গামাটি চারপাশ দেখা যাচ্ছে। সময় অন্য একটি দলের একজন জানালেন, মেঘ না থাকলে নাকি ফুরমোন থেকে চট্টগ্রাম নগরীও দেখা যায়।

ঘণ্টা সময় কাটানোর পর বেলা ২টার দিকেই আমরা ফের শহরের উদ্দেশ্যে ভিন্ন পথে রওনা দিলাম। এটি অবশ্য আসার পথের মতো সলিং রাস্তাও না। বড় সিঁড়িও নেই। এক পাড়ে নির্জন-পাহাড়ি পথ। রাস্তাটাও বেশ সরু ঝুঁকিপূর্ণ। পথ বেশ দেখেশুনেই পাড়ি দিতে হয়। তার পরও সে পথেই হেঁটে চলমান। ২৫ মিনিটের মতো পাহাড়ি জঙ্গলের রাস্তার পর একটি বিশাল বটগাছের নিচে প্রায় আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিলাম। পরে হেঁটে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রামের মূল সড়কের সাপছড়িতেই পৌঁছালাম। পথে হেঁটে আসতে মূল রাস্তার পাশে কয়েকটি আদিবাসী পরিবারের ঘর। যাওয়ার পথে মূল রাস্তার পাশে কোনো বাড়িঘরের চিহ্ন দেখতে পাইনি আমরা। সব মিলিয়ে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম পাহাড়ের ভালোবাসায়। এখনো চোখ বন্ধ করলে ভেসে বেড়ায় ফুরমোন পাহাড়, ফুরমোন চূড়া, ভালোবাসার ফুরমোন।

পাহাড়ে থাকা-খাওয়া বা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। পাহাড়ের চূড়ার অনতি দূরে একটি চায়ের দোকান আছে। দোকানটিতে চা ছাড়া তেমন খাবার মেলে না। তাই ট্রেকিংয়ের সময় সঙ্গে খাবার নিয়ে যাওয়াই ভালো।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা চট্টগ্রাম শহর থেকে বাসে রাঙ্গামাটি শহরে যাওয়া যায়। চট্টগ্রাম শহরের অক্সিজেন মোড় থেকেপাহাড়িকাবাস ছাড়ে। জনপ্রতি ভাড়া ১২০ টাকা। ঢাকা শহরের ফকিরাপুল, কলাবাগানসহ বিভিন্ন কাউন্টার থেকে রাঙ্গামাটির উদ্দেশে বিভিন্ন পরিবহনের বাস যায়। মানভেদে ভাড়া ৬০০ থেকে হাজার ৫০০ টাকা। রাঙ্গামাটি পৌঁছে শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা অন্য যেকোনো মোটরগাড়িতে ফুরমোন পাহাড়ের পাদদেশে যাওয়া যায়। ঘণ্টা হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে।

 

 প্রান্ত রনি

সাংবাদিক ভ্রমণপ্রেমী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন