মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানে পোশাক
শিল্পের গোড়াপত্তন দুই দশক আগে। এরপর থেকে বিকাশ ঘটতে থাকে শিল্পটির। তবে দেশটির
পোশাক শিল্পের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন প্রবাসী শ্রমিকরা, যাদের
বড় অংশই বাংলাদেশী। আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে, জর্ডানের পোশাক শিল্পে কর্মরত প্রবাসী
শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালের ৪৯ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে
তা বেড়ে হয়েছে ৫৬ শতাংশ।
জর্ডানের শিল্প খাতের কমপ্লায়েন্স
পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৮ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের
(আইএফসি)
যৌথ উদ্যোগ ‘বেটারওয়ার্ক’। ‘অ্যানুয়াল
রিপোর্ট ২০১৭: অ্যান ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স রিভিউ’ শীর্ষক ওই
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জর্ডানের পোশাক শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মাত্র
১৬ হাজার স্থানীয় শ্রমিক। বাকি ৪৯ হাজারই বেশি অভিবাসী শ্রমিক, এদের
প্রায় সবাই নারী। আর অভিবাসী শ্রমিকদের ৪৯ শতাংশ অর্থাৎ ২৪ হাজারই বাংলাদেশী।
সদ্য সমাপ্ত বছরের ‘অ্যানুয়াল
রিপোর্ট ২০১৯: অ্যান ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স রিভিউ’ শীর্ষক
প্রতিবেদন বলছে, জর্ডানের পোশাক কারখানায় অভিবাসী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। অংশগ্রহণ
বেড়েছে এমন শ্রমিকদের বেশির ভাগই বাংলাদেশী। ২০১৮ সালে জর্ডানের পোশাক কারখানায়
বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা ৫৬ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া শ্রীলংকার
শ্রমিকের সংখ্যা ১৭ শতাংশ, ভারতের ১১ শতাংশ। এছাড়া দেশটির পোশাক কারখানাগুলোয় কর্মরত শ্রমিকদের
মধ্যে রয়েছে নেপাল, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের নাগরিক।
বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের
ক্ষেত্রে কিছু অনিয়মের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৮
সালে আইএলওর পক্ষ থেকে জর্ডানের শ্রম মন্ত্রণালয়ে শিশুশ্রমের দুটি ঘটনা উত্থাপন
করা হয়। দুটি ঘটনাই বাংলাদেশী শ্রমিকের বিরুদ্ধে পাসপোর্টে বয়স জালিয়াতির। আইএলও
বেটারওয়ার্কের মূল্যায়ন পরিদর্শনের সময় একটি কারখানায় একজন বাংলাদেশী শ্রমিকের বসয়
১৪ বছর বলে শ্রমিক নিজেই স্বীকার করেন। আরেকটি কারখানায় মূল্যায়ন চলাকালীন শ্রমিক
কারখানার গুদামে লুকিয়ে ছিলেন বলে শনাক্ত করেন আইএলও প্রতিনিধিরা।
এছাড়া জর্ডানে অভিবাসী বাংলাদেশী
শ্রমিকদের রিক্রুটমেন্ট ফি বাবদ নারীদের তুলনায় পুরুষদের কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায়
করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইএলও। সেখানে বলা হয়েছে, একই
কারখানায় বাংলাদেশের পুরুষ শ্রমিকরা রিক্রুটমেন্ট ফি বাবদ নারী শ্রমিকের তুলনায়
২০০ ডলার বেশি পরিশোধ করেছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জর্ডানের
পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ে ৩ লাখ ৪০
হাজারেরও বেশি অভিবাসী ও শরণার্থী শ্রমিক নিবন্ধন নিয়েছে। নিবন্ধিত শ্রমিকের
অধিকাংশই মিসর, বাংলাদেশ ও সিরিয়ার। কৃষি,
নির্মাণ ও উৎপাদনমুখী খাতে এ শ্রমিকদের
কর্মসংস্থান হচ্ছে। নিবন্ধিত শ্রমিকদের মধ্যে মিসরীয় পুরুষরা নির্মাণ খাতে, অন্যদিকে
বাংলাদেশ নারী শ্রমিকরা গৃহস্থালি ও পোশাক কারখানায় কর্মরত।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের শ্রমিক
প্রতিনিধিরা বলছেন, বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক পোশাক কারখানা থাকার পরও বাড়তি মুনাফার (মজুরি) কারণেই
মূলত জর্ডানের পোশাক শিল্পকে বেছে নিচ্ছেন শ্রমিকরা। পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতির
বিষয়টিও কাজ করছে এর পেছনে।
আইএলও বেটারওয়ার্ক বলছে, তাদের
সমীক্ষার আওতায় ছিল মোট ৭৯টি কারখানা। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হচ্ছে মোট ৬৫
হাজার ২৭২ জনের। এর মধ্যে ৪৯ হাজারই নারী শ্রমিক। এসব শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র
কারখানার কমপ্লায়েন্স ও নন-কমপ্লায়েন্স পর্যালোচনায় জরিপের মাধ্যমে বেশকিছু বিষয় উপস্থাপন করা
হয়েছে আইএলওর ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে। এতে কমপ্লায়েন্স ও নন-কমপ্লায়েন্স
পর্যালোচনার মাপকাঠির মধ্যে ছিল শিশুশ্রম,
বৈষম্য,
জোরপূর্বক শ্রম, স্বাধীন শ্রম সংঘ ও দরকষাকষির অধিকার, ক্ষতিপূরণ, কর্মচুক্তি, পেশাগত
নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কর্মঘণ্টা।
বেটারওয়ার্কের প্রতিবেদনটি
সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা
আক্তার। তিনি বলেন, জর্ডানসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা কাজ করছেন।
আমরা এ বিষয়ে শ্রমিকদের সব সময় নিরুৎসাহিত করি। কারণ সেখানে অনেক ধরনের নির্যাতনের
শিকার হতে হয় শ্রমিকদের। এছাড়া কর্মঘণ্টাও অনেক বেশি। আসলে শ্রমিক শোষণের চিত্র
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই একই রকম। তাই সার্বিকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে শ্রম অধিকার
জর্ডানে খুব ভালো এটা বলা যাবে না। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বেশি মজুরির প্রাপ্তির
নিশ্চয়তার কারণেই পোশাক শ্রমিকরা জর্ডানের মতো আরো অনেক দেশে গিয়ে কাজ করছেন।
বেটারওয়ার্কের প্রতিবেদনে জর্ডানের
পোশাক শিল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে,
পোশাক শিল্প জর্ডানের জন্য ঐতিহাসিক কোনো
গুরুত্ব বহন করে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পাঞ্চলবিষয়ক চুক্তির মাধ্যমে
দেশটিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায় জর্ডান। এরপর ১৯৯০-৯৬ সালের মধ্যে ব্যাপক
প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেশটির পোশাক শিল্প। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত
বাণিজ্য চুক্তিও হয় জর্ডানের।
বর্তমানে জর্ডানের মোট রফতানিতে পোশাক
শিল্পের অবদান ১৯ শতাংশ। খাতটি থেকে দেশটির আয় হয় বছরে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
২০১৬ সালে দেশটির পোশাক রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশটিতে
রফতানিমুখী পোশাক কারখানার সংখ্যা ৮১টি। এর মধ্যে ৩৫টি সরাসরি ও ৩০টি ঠিকা (সাব-কন্ট্র্যাক্ট) পদ্ধতিতে
পরিচালিত। এছাড়া বাকি ১৬টি স্যাটেলাইট ইউনিট।