২০২০ ও ২০২১ সাল বাংলাদেশের জন্য
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করব আমরা। এ উপলক্ষে
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন,
জাতির পিতার ঋণ আমাদের পরিশোধ করতে হবে। তার
সঙ্গে সেই অফুরন্ত সম্পদ, যা লুক্কায়িত আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, চিন্তা-চেতনা ও দর্শনে, তা
ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, যার
সব কিছুই একবিংশ শতাব্দীতেও পরিপূর্ণ প্রাসঙ্গিক, আধুনিক ও যুগোপযোগী। সারা বিশ্বের
নিপীড়িত, নির্যাতিত, বৈষম্যের শিকার মানুষের মুক্তির জন্য এ কাজ যদি আমরা করতে পারি, তাহলেই
কেবল আমরা নিজেদের কৃতার্থ ভাবতে পারব। তাই নতুন বছরে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভেদ ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে কাজ করা। অবিচল প্রচেষ্টায়
আগামীর সুখময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় কাজ করে যাওয়াও জরুরি।
নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এরই মধ্যে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি। মধ্যম আয়ের দেশ
হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিশ্রম, সততা
ও আন্তরিকতাপূর্ণ সংকল্প নিয়ে কর্মোদ্যমী হওয়া দরকার। শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারা
বেগবান, ব্যাপক হারে শিল্পায়নের মাধ্যমে বেকারত্ব মোচন, আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির
দ্বারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ,
কৃষি খাতকে আধুনিকায়ন, সব
সেক্টরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা,
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির
মাধ্যমে আমরা এ নতুন বছরকে প্রাপ্তিতে অর্থবহ করে তুলতে পারি। সরকারের পাশাপাশি
বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতের দেশ গঠনের শুভ উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। নতুন আশায়
বুক বেঁধে আমাদের এগোতে হবে,
নিরাশ হলে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই বেশি।
অস্বস্তির বিষয় হলো, ব্যাংকিং
খাতে বিশৃঙ্খলা, খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ
লাভ করলেও সহজ ব্যবসার সূচকে অনেক পিছিয়ে আছে। এসব আশাবাদ ও ভবিষ্যদ্বাণী তখনই
কার্যকর হবে, যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনা যাবে। আওয়ামী লীগ
নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর কথা বলেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নতুন সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সচেষ্ট থাকলে, প্রশাসনে
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অসম্ভব নয়। নতুন বছরে ব্যাংক
খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। কারণ সঞ্চয়পত্রের
সুদ হার অপরিবর্তিত থাকলে আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে আরো অনেক কমে যেতে পারে।
এতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা আরো কমে যাবে, যার বিরূপ প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে
পড়তে পারে। অতএব, বছরের শুরু থেকে এ বিষয়ে ব্যাংকিং খাতে বিশেষ সচেতনতা ও সতর্কতা
অবলম্বন করতে হবে। নতুন বছরে নতুন সরকারের হাত ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ
ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু প্রবৃদ্ধিই নয়, অন্যান্য
সূচকের ওপরও নির্ভর করে অর্থনৈতিক ভিত্তি। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া
সরকারকে দিতে হবে সর্বোচ্চ নজর। ব্যাংক খাতের সংস্কার ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর
ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব আহরণের গতি বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
নতুন বছরের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে
রফতানি বিশেষত পোশাক রফতানি বাড়ানো। কেননা গেল বছরের শেষ ছয় মাসে আমাদের রফতানি
প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল না।
বিদেশী বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে উন্নতির
লক্ষণ ২০১৯ সালে দেখা যায়নি। বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে খুবই কম। সরকারি বিনিয়োগ কিছু
আছে। স্থানীয় বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে না। এর মধ্যে সবচেয়ে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু।
কিন্তু এর কাজের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। এছাড়া বড় কিছু প্রকল্প আছে। কিন্তু গ্যাস
ও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের খবর বিরল। অথচ সবাই জানি, বিনিয়োগ ছাড়া ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির
লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন এক কাজ। সাড়ে ৭ শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করতে হলে ৩০
শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। অথচ তার লক্ষণ নেই। ব্যাংকে ব্যাংকে প্রচুর টাকা অকেজো পড়ে
আছে। ঋণের সুদের হারও কমেছে। অনেক ব্যাংকে এক অংকের সুদ হার চালু হয়েছে। নির্বাচিত
গ্রাহকদের বিদেশ থেকে ঋণ করার অনুমোদনও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে
আসছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো খবর পাওয়া যাচ্ছে পুঁজি পাচারের।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের
কাতারে চলে এসেছে। তবে দেশে অতি ধনীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত হারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই
অতি ধনী বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক। অক্সফামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নয়নের
সুবিধা অধিকাংশই ধনিক শ্রেণীর দখলে চলে যাচ্ছে। অক্সফাম প্রবৃদ্ধিকে সংখ্যা দিয়ে
না দেখে গুণগত মান দেখার পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলছে, প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে
কিনা, তা দেখতে হবে। আয়বৈষম্যের কারণে দারিদ্র্য বিমোচনে প্রবৃদ্ধির
কার্যকারিতা কমেছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমাতে হলে দেশে আইনের শাসন, জবাবদিহিমূলক
শাসন প্রতিষ্ঠা, বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন তথা
কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে।
ব্যাংকিং খাতে ক্রনিক রোগের মতোই
খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। সুশাসনেও ঘাটতি রয়ে গেছে এ খাতে। যথেষ্ট পরিমাণে ব্যাংক
থাকার পর নতুন আরো কয়েকটি ব্যাংক আসছে,
সরকারি অনুমোদন পেয়েছে। নতুন বছরে নতুন সরকারকে
এদিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আগামী পাঁচ
বছরের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে,
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে
খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নের টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি
নির্ণয় করা হবে। আমাদের প্রত্যাশা বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কেন্দ্রীয়
ব্যাংক বিচক্ষণতার সঙ্গে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখবে; ঋণ
অনুমোদন ও অর্থ ছাড়ে দক্ষতা এবং গ্রাহকের প্রতি ব্যাংকের দায়বদ্ধতা পরিবীক্ষণের
জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নেবে। নতুন বছরে মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং
সম্পদের বণ্টন আরো মসৃণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
নিশ্চিত করা জরুরি। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে
উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ২০২০ সাল
সবার জন্য শুভ হোক।