অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে পথ দেখিয়েছেন

আতিউর রহমান

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, আমাদের দেশে সকলের চেয়ে বেশী দরকার হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারা লক্ষ করলেই এর যথার্থতা প্রমাণ হয়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ছাই-ভস্মের মধ্য থেকে যাত্রা করা বাংলাদেশ অভাবনীয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে পাঁচ দশকেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্বের সামনে হাজির হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। দেশের চিরসংগ্রামী মানুষের মনে সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করা গেছেন বলেই অর্জন সম্ভব হয়েছে। মানুষের মনে ভরসা তৈরির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু চেতনা। সেই চেতনার সূত্র ধরেই -সরকারি খাতের নানা উদ্ভাবনী, অংশগ্রহণমূলক জনবান্ধব উদ্যোগ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। শুরু থেকেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারি নীতি কর্মসূচির সম্পূরক -সরকারি উন্নয়ন উদ্যোগে যে হাতেগোনা কিছু মানুষ নেতৃত্ব দিয়েছে, ফজলে হাসান আবেদ তাঁদের একজন। সাহসী আবেদ ভাই আর তাঁর প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক তাই দেশের মানুষের কাছে অন্যতম ভরসার প্রতীক। দিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আমাদের ভরসার প্রতীক। পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ঘরোয়া আলোচনায়-সর্বত্রই চলছে কৃতজ্ঞ চিত্তে আবেদ ভাইকে স্মরণ। আমি নিজেও লিখেছি, বলেছি তাঁকে নিয়ে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রতি আমাদের ঋণের শেষ নেই। শুধু আমরা কেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের মাধ্যমে তিনি পৌঁছে গেছেন সারা বিশ্বের আর্তমানবতার কাছে। তাই দেশের গুণীজনদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরাও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তাঁর প্রতি। লেখাতেও তাঁকে স্মরণ করছি, আর পাশাপাশি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্ভাবনী উন্নয়ন চিন্তা কর্মের যে দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আবেদ ভাই রেখে গেছেন, তার বিশেষত্বগুলো। তাঁর দেখানো পথ যদি বাংলাদেশের মানুষকে, বিশেষত দেশের তরুণদের অনুপ্রাণিত করে, তবে সত্যিই আমরা আমাদের জাতীয় সামষ্টিক লক্ষ্যগুলো যথাসময়ে অর্জন করতে পারব।

তরুণ বয়সে, সেই ষাটের দশকে, দেশের অধিকাংশ প্রতিভাবান তরুণের মতোই বিদেশে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন আবেদ। নেভাল আর্কিটেকচার পড়ার জন্য বৃত্তি নিয়ে গ্লাসগোতে গেলেও ওই বিষয়ে অর্জিত জ্ঞান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল তাঁর। তাই বিষয় পরিবর্তন করে পড়েছিলেন কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্সি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট পড়া শেষে চাকরিও পেয়েছিলেন বহুজাতিক কোম্পানিতে। কিন্তু ১৯৭০-এর ভয়াবহ সাইক্লোন আর পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানুষের বিপন্নতা তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে প্রত্যাগত শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য গড়ে তোলেন ব্র্যাক। আর বাকিটা ইতিহাস। দরিদ্র আর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের যে মডেল তিনি ধীরে ধীরে দাঁড় করিয়েছেন, তা আজ সারা বিশ্বে অনুসৃত হচ্ছে। আজকের বাংলাদেশেও তরুণরা বিদেশে যাচ্ছে, পড়ালেখা করছে, অনেকে দেশেও ফিরছে। তাদের জন্য দেশপ্রেমিক ফজলে হাসান আবেদ হতে পারেন অনন্য দৃষ্টান্ত। সময়ের শিক্ষার্থীরাও যদি জ্ঞানার্জনের সময় মাথায় রাখে ওই অর্জিত জ্ঞান দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চাহিদা কতটা মেটাতে পারবে, যদি তারাও পড়ালেখা শেষে কেবল চাকরির জন্য বসে না থেকে নিজেরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া আরো বহুগুণে বেগবান হবে সন্দেহ নেই।

ফজলে হাসান আবেদকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, যারা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন তারা তো বটেই, সাধারণ অর্থে সবাই জানেন, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অভাজন?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন