সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে—এমন দাবি উন্নত থেকে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর নাগরিকদের এক ধরনের তৃপ্তির সঞ্চার করে। কিন্তু এ দাবির অন্তরালে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নামে দাস প্রথার প্রচলন বর্তমান সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। শুধু দাস প্রথাকে শ্রমশক্তি বলা ছাড়া তাদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাত্রা, কাজের চাপ, নির্যাতন, নিয়োগদাতাকে খুশি করতে না পারা এসবের কিছুই পরিবর্তন হয়নি। এমনকি ম্যান পাওয়ার ব্যবসার নামে প্রতারকরাও দাস ব্যবসায়ীর পরিবর্তিত রূপ ধরে এসব শ্রমিককে বিদেশে পাঠিয়ে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করছে দেশে দেশে।
অবশ্য পরিবর্তন আসেনি তাও নয়, শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশী-বিদেশী আইন হয়েছে। কিন্তু তাতে গুণগত পরিবর্তন আসেনি, শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা কোনো সময়েই কমেনি। উন্নত দেশগুলোয়ও মানবাধিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমুন্নত থাকলেও অজানা কারণে এই একটি দিক থেকে পৃথিবীকে একসঙ্গে পরিবর্তনের যে ধারণা, সেটি একে অন্যকে দিতে পারেনি। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য নীতি, নারীর ক্ষমতায়ন—এ ধরনের বিষয়গুলোয় এক দেশ আরেক দেশের প্রতি পরিবর্তনের বার্তা দিয়েছে এবং কার্যকরী উদ্যোগও নিয়েছে। ফলে এ রকম অনেক ক্ষেত্রে সব দেশ আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে কিন্তু গৃহশ্রমিকদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। এছাড়া মানবাধিকার পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবেও এটিকে কোথাও রাখা হয় না, যার কারণে অস্ট্রেলিয়ায়ও ভালো নেই গৃহকর্মীরা।
২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে সেখানে গৃহকর্মীদের সর্বোচ্চ ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো, বেতন না দেয়া এবং শারীরিক নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িগুলোকে ‘কারাগারে’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে অথচ অস্ট্রেলিয়ায় অন্য দেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীর সংখ্যা খুবই কম, বেশির ভাগই সে দেশের আর্মি নিয়োগ দেয়। আর কেউ কেউ মানব পাচারের শিকার। এমনকি গৃহকর্মী হিসেবে যখন বাংলাদেশ থেকে নারীরা বিভিন্ন দেশে যান, সেখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শর্ত থাকে—নিয়োগদাতার ছাড়পত্র ছাড়া কোনো শ্রমিক সেই স্থান থেকে অন্য কোনো স্থানে যেতে পারবেন না। এ ধরনের নিয়ম দাস প্রথাকেই মনে করিয়ে দেয়।
বর্তমানে বিশ্বে ৬৭ দশমিক ১ মিলিয়ন গৃহশ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ২৫ নারীর মধ্যে একজন গৃহকর্মী হয়ে বাঁচেন। বাংলাদেশেও নারী শ্রমিকের বিদেশ যাত্রার হার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বিদেশে গিয়ে মৃত্যুর হার। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৯৩ জন নারী শ্রমিক প্রবাসে মৃত্যুবরণ করেছেন। সম্প্রতি সরকার থেকে প্রকাশিত এক তথ্য বিবরণীতে এ সংখ্যা পাওয়া গেছে। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় চলতি বছর ৪৮ জন নারী গৃহকর্মীর মরদেহ সৌদি আরব থেকে দেশে আনা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ২০ জনই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন। ৪৮ জনের মধ্যে ২০ জনের আত্মহত্যা নারী শ্রমিকদের প্রতি সহিংসতার মাত্রা কত বেশি তা নির্দেশ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না,