কিমের দেশের অর্থনীতির ৯ চমক

মাত্র আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশ উত্তর কোরিয়া। অনেকটা গোপন রাষ্ট্রের মতো এ সমাজাতান্ত্রিক দেশ নিয়ে গালগল্পের শেষ নেই। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে দেশটি সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন দেশটি সম্পর্কে বিভিন্ন মাধ্যমে যা কিছু জানা যায় তার অনেক কিছুই অনুমাননির্ভর। আবার এর মধ্যে অপপ্রচারও রয়েছে। তারপরও উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যে নিম্ন, প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে প্রায় খাদ্য সংকট দেখা দেয় তা নিশ্চিত। কারণ ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা মেটাতে দেশটিকে জাতিসংঘের ওপর নির্ভর করতেই হয়। সে কথা অবশ্য অস্বীকার করেন না উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। বিভিন্ন সূত্র ও তথ্য উৎসের বরাত দিয়ে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির নয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকা:

পুষ্টিহীনতায় ভোগে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ
২০০০ সালের পর উত্তর কোরিয়ায় অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। পুষ্টিহীনতার শিকার মানুষের হার ৩৭ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ সময়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে পুষ্টিহীনতার হার কমাতে পেরেছে দেশটি। এরপরও উত্তর কোরিয়া কিন্তু অপুষ্টি সমস্যায় আক্রান্ত দেশের মধ্যে শীর্ষ নয়। ক্ষুধা সূচকে ১৯৯টি দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান ১০৯। মূলত ১৯৯০ এর দশকে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের পর দেশটির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়েছে। ওই দূর্ভিক্ষে ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

কার্যত কেউই ইন্টারনেট ব্যবহার করে না
কিম জং উনের সরকার নাগরিকদের ইন্টারনেট ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারের নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্বলিত সার্ভার হয়ে ওয়েব সার্ফ করতে হয়। এ কারণে ১ শতাংশের বেশি নাগরিককে কখনো ভার্চুয়াল জগতে খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগরিকদের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক, কোয়াংমায়োং ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়। এ ইন্টারনেট সেবা অবশ্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পায় নাগরিকরা। তবে নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইট ছাড়া ব্রাউজ করা সম্ভব হয় না।

তবে টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, উত্তর কোরিয়ায় সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। এটি শুধু রাজনৈতিক নেতানেত্রী, তাদের পরিবার, অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং দেশের হয়ে যারা সাইবার যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদের জন্য বরাদ্দ।

ভক্সের একটি প্রতিবেদন দাবি করা হয়, কোয়াংমায়োং নেটওয়ার্কে নিজস্ব ইমেইল ও ব্রাউজার টুলস রয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইট যখন উত্তর কোরিয়ার সার্ভারে প্রবেশ করে তখন সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রয়োজনীয় সেন্সর করার পরই ব্রাউজারে প্রদর্শন করে। অর্থাৎ সাধারণত ইন্টারনেটে কোনো ওয়েবসাইট যেভাবে থাকে উত্তর কোরিয়াতে সেটি দেখার অনুমতি থাকলেও আসল ওয়েবসাইটটির বদলে সেটির একটি সেন্সর করা সংস্করণ দেখা যাবে।

ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ
নানা কারণে উত্তর কোরিয়ার মানুষ শোচনীয় জীবনযাপন করলেও দেশটির মাটির তলায় আছে ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন= ১ লাখ কোটি) মূল্যমানের খনিজ সম্পদ। কোয়ার্টজের হিসাবে, কিম জং উনের দেশের মোট খনিজের মূল্যমান হতে পারে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার। আরেক হিসাবে বলা হয়, এটি ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের কম নয়।

উত্তর কোরিয়ার ভূগর্ভে রয়েছে লোহা, স্বর্ণ, জিঙ্ক, তামা ও গ্রাফাইটসহ দুই শতাধিক ধরনের খনিজ। এছাড়া বিপুল পরিমান বিরল মৃত্তিকাও (রেয়ার আর্থ) রয়েছে দেশটির খনিতে। স্মার্টফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান রয়েছে এ বিরল মৃত্তিকায়। বর্তমানে চীন এ খনিজের বৃহত্তম উৎপাদক ও রফতানিকারক। উত্তর কোরিয়ার এ বিরল মৃত্তিকার মূল্যমান দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাংসহ বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির মোট বাজারমূল্যের চেয়েও বেশি বলে মনে করা হয়।

তবে দেশটির খনি ব্যবস্থাপনা খুবই নিম্নমানের বলে জানিয়েছে কোয়ার্টজ। মূল্যবান খনিজ আহরণে যথেষ্ট দক্ষতা নেই উত্তর কোরিয়ার। এছাড়া বেসরকারিভাবে খনিজ আহরণের অনুমতিও নেই।

ব্রান্ডির পেছনে বছরে খরচ ৮ লাখ ডলার
উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত নেতা কিম জং ইল নাকি একটি ফরাসি ব্রান্ডির পেছনে বছরে খরচ করতেন ৮ লাখ ডলার। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, হেনিসি ব্র্যান্ডের ব্রান্ডি পান করতেন তিনি।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কনিয়াক প্রস্তুতকারক কোম্পানিটির বরাত দিয়ে জানায়, ১৯৯০ এর দশকের মাঝমাঝিতে টানা দুই বছর হেনিসি ব্রান্ডির প্রধান ক্রেতা ছিলেন কিম। উত্তর কোরিয়াতে এক বোতল হেনিসির খুচরা মূল্য ৬৩০ ডলার। যেখানে দেশটির মাথাপিছু আয় ১০০০ থেকে ২০০০ ডলার।

এক দেশে দুই অর্থনীতি, দুই মূল্য ব্যবস্থা
কমিউনিস্ট দেশ হলেও উত্তর কোরিয়াতে রয়েছে দুই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। জাতীয় অর্থনীতি মানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি আর রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতি। আর এ কারণে সব পণ্যের জন্য দুই ধরনের মূল্য ব্যবস্থাও রয়েছে। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিল ব্রাউন গত বছর মার্কেটপ্লেসকে এ তথ্য দেন। কোনো নাগরিক যদি চীনা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তাহলে তার বেতনের একটি অংশ অবশ্যই রাষ্ট্রকে দিতে হবে। পিইয়ং ইয়ংয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত টেক্সটাইল কারখানার একজন শ্রমিক মাসে ৩০০০ উত্তর কোরীয় উন আয় করেন। একই শ্রমিক যদি চীনা কারখানায় কাজ করেন তাহলে এর একশ গুণ আয় করবেন। ফলে শ্রমের মজুরি নির্ধারণেও বড় ধরনের একটি অব্যবস্থাপনা রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক বিল ব্রাউন।

দুই কোরিয়া একীভূতকরণ প্রকল্পে রাস্তা তৈরিতে বাজটে ৩৯ লাখ ডলার
আন্তঃকোরিয়া সহযোগিতা ও বিনিময় কাউন্সিলের জন্য সম্প্রতি ৩৯ লাখ ডলার বরাদ্দ করেছে উত্তর কোরিয়া। দুই কোরিয়াকে বিভক্তকারী বেসামরিক এলাকায় (ডিমিলিটারাইজড জোন- ডিএমজি) পাহাড়ে ওঠার রাস্তা তৈরিতে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দুই কোরিয়া সম্মত হয়েছে। সম্প্রতি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া সেখান থেকে ১১টি রক্ষী পদ বিলুপ্ত করেছে।

হ্যাকারদের ৬৭ কোটি বৈদেশিক ও ভার্চুয়াল মুদ্রা চুরি
অনেকে বলে থাকেন উত্তর কোরিয়ার আয়ের অন্যতম একটি উৎস হ্যাকিং। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হ্যাকাররা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থচুরি ও মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা এ যাব্ত ৬৭ কোটি ডলার বিদেশী ও ভার্চুয়াল মুদ্রা চুরি করেছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, ভারতের কসমস ব্যাংকের ১ কোটি ৩৫ লাখ ডলার এবং ব্যাংক অব চিলির এটিএম নেটওয়ার্ক থেকে ১ কোটি ডলার চুরি করেছে তারা।

বছরে অবৈধ আয় ৫ কোটি ডলার
শুধু হ্যাকিং নয়, মাদক চোরাচালন ও জাল ডলার বানিয়ে বছরে প্রায় ৫ কোটি ডলার আয় করে উত্তর কোরিয়া। অবশ্য দেশটি সব সময়ই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। যদিও অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে কি জং উনের সরকার কখনোই জাতীয় অর্থনীতির প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। জাতিসংঘের মতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ কিমের বিলাসী জীবনযাপনে ব্যয় করা হয়।

নাগরিকত্ব প্রত্যাহারের খরচ ১২ হাজার ডলার
কেউ উত্তর কোরিয়ার নাগরিকত্ব ছাড়তে চাইলে তাকে মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। মূলত কাজটি কঠিন করতেই ২০১১ সালের শেষ নাগাদ ক্ষমতায় আরোহণের পর এমন ব্যবস্থা নেন কিম জং উন। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার নাকরিকত্ব ছাড়তে চাইলে মধ্যস্থতাকারীকে ১২ হাজার ডলার দিতে হয়। অন্য সূত্রে জানা যায়, এ প্রক্রিয়া রফা করতে কখনো কখনো দালালকে ১৭ হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে হয়।

২০১২ সালের আগে নাগরিকত্ব প্রত্যাহারের খরচ ছিল ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ডলার। একুশ শতকের প্রথম দশকে এ খরচ মাত্র ৪৫ ডলার ছিল বলে জানায় একাধিক মানবাধিকার গ্রুপ।

উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের গড় বাৎসরিক আয় ২ হাজার ডলার। ফলে কেউ নাগরিকত্ব ছাড়তে চাইলে পরিবারের এমন কোনো সদস্য বা স্বজন থাকতে হয়, যিনি এরই মধ্যে নাকরিকত্ব ছেড়েছেন অথবা ওই পরিমান টাকা দেয়ার মতো সামর্থ্য তার আছে।

এ কারণে নাগরিকত্ব ছাড়ার একটি সাধারণ কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে গোপনে নদী সাঁতরে সীমান্ত পেরিয়ে চীনে চলে যাওয়া। তবে সীমান্ত পাহারা জোরদার করার কারণে সেটিও এখন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন