গাজী মাজহারুল আনোয়ার একাধারে সুরকার-গীতিকার, চলচ্চিত্র
পরিচালক ও প্রযোজক। স্বাধীনতা ও দেশ নিয়ে অসংখ্য কালজয়ী গান রচনা করেছেন তিনি।
অন্যদিকে লুবনা মারিয়াম নৃত্য গবেষক ও শিল্পী। সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে তরুণ
প্রজন্ম স্বাধীনতা, দেশ, মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে উপস্থাপন করছে—সে প্রসঙ্গে টকিজের সঙ্গে কথা হয় এ
দুই শিল্পীর।
‘তরুণ শিল্পীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর দায়িত্ব আমাদের’
—গাজী মাজহারুল আনোয়ার
আমরা যারা সংগীতাঙ্গনে আছি, দেশ
ও তরুণ প্রজন্মের প্রতি তাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষকে
উদ্বুদ্ধ করার জন্য দেশাত্মবোধক অনেক গানের সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের
অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য আমরা অনেক গান করেছি। এটা আমাদের দায়িত্ববোধের মধ্যে
পড়েছিল। যারা যে অঙ্গনে ছিল,
সেখান থেকে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। দেশকে
সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষরা নিবেদিত হয়ে কাজ করেছে। এখন আমরা
স্বাধীনতা অর্জন করেছি, একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ফলে দেশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখার সুযোগ
আমাদের আছে। সেই সুযোগের একটি হলো অতীতের সব ইতিহাসকে এ তরুণ প্রজন্ম ও
সংগীতশিল্পীদের সামনে তুলে ধরতে হবে। যাদের কর্মে-ত্যাগে, অনুপ্রেরণা, উৎসাহে
আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, তাদের সম্পর্কে তরুণদের জানাতে হবে। আমরা যারা প্রবীণ, তাদেরকেই
এ কাজ করতে হবে। নবীনরা যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারে না। অনেক
প্রাণের বিনিময়ে, অনেক লড়াই করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এ আদর্শ তাদের ভেতরে যদি
আমরা রোপণ করতে পারি, তার ইতিবাচক ফল দেশ একসময় পাবে। তাদেরকে অতীত ইতিহাস জানানোর দায়িত্ব
আমাদের। এ দায়িত্ব যদি আমরা যথাযথভাবে পালন করি, তাহলে আমার মনে হয় তরুণদের আমরা
অনুপ্রাণিত করতে পারব। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের আদর্শ তৈরি হবে। এ আদর্শবোধ থেকে
তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা তাদের সুন্দর কণ্ঠ দিয়ে মানুষের জন্য গান করবে।
‘মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যও নৃত্যে তুলে ধরতে হবে’
—লুবনা মারিয়াম
ষাটের দশক থেকে একাত্তর—পুরোটা সময়জুড়ে
আমরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গেছি। একাত্তরে আমার বয়স ছিল ১৭। আমি মনে করি, আমাদের
প্রজন্মের সৌভাগ্য আমরা সেসময় সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলাম।
আবার দেশের জন্য যুদ্ধ করারও সুযোগ পেয়েছিলাম। সব প্রজন্মের এ সুযোগ হয় না। কিন্তু
আমার মনে হয়, আমাদের যুদ্ধ এখনো চলমান। আমরা সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে আগেও আন্দোলন
করেছি, এখনো করে যাচ্ছি। যুদ্ধ সব সময় অস্ত্র হাতে করতে হয়, তা
কিন্তু নয়। যে যেখানে আছি, সেখান থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করাও এক প্রকারের যুদ্ধ।
নাচ সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী
মাধ্যম। তাই নৃত্যকে শুধু বিনোদন হিসেবে না দেখে যদি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার
হিসেবে দেখা হয়, তাহলে আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চা আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এবং সফল হবে।
আমি খুব আশাবাদী। নৃত্য সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে চলেছে। শুধু
ঢাকা নয় ঢাকার বাইরের সংগঠনগুলোও নাচ নিয়ে দেশে-বিদেশে ভালো কাজ করছে। তবে নাচকে
কীভাবে পরিবর্তনের মঞ্চ হিসেবে গড়ে তোলা যায়—সে বিষয়ে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি সমাজের
বৈষম্য, নারী-পুরুষের ভেদাভেদ,
অনৈক্য—এ বিষয়গুলো নাচের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। এগুলোও কিন্তু এক ধরনের
যুদ্ধ। আমাদের এখনো দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া বাকি। সবাই যার যার জায়গা থেকে চেষ্টা
চালাচ্ছে। আমি আশা রাখি, তরুণ প্রজন্ম অনেক সুন্দর কাজ করবে। তাদের হাত ধরে নাচের জগতে আরো অনেক
পরিবর্তন আসবে। কারণ তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমাদের
সময় তো শেষ হতে চলেছে। এখন আমাদের প্রবীণদের কাজ হলো তরুণ প্রজন্মকে নতুন পথ
দেখানো। নৃত্যের সঙ্গে তাদের নতুন নতুন সংযোগ তৈরি করে দেয়া। নাচ নিয়ে তরুণ
প্রজন্মের কাজ ও চিন্তা—অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আমি একটি বিষয়ের
অভাব লক্ষ করি, সেটা হলো তাদের ভেতরে প্রগতিশীল রাজনীতি ও মতাদর্শের অভাব রয়েছে। তবে আমি আশা রাখি, তরুণরা
একদিন এ সমস্যা কাটিয়ে উঠবে ও সামনে এগিয়ে যাবে।
শ্রুতলিখন: রাইসা
জান্নাত