একাত্তরে
বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী ডাক্তারদের কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বিপন্ন মানুষের সেবা করেছেন। কেউ কেউ দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করেছেন। ডাক্তার জন এলিয়ট রোহ্ড ইউএসএআইডির পূর্ব পাকিস্তান অংশে কলেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ডাক্তার ডেভিড আর ন্যালিন ওআরএস উদ্ভাবকদের একজন। ডাক্তার মেয়ার কারিতাস ভারতের সঙ্গে কর্মরত ছিলেন। বিবেক জাগ্রত করতে লেখা তিন বিদেশী ডাক্তারের তিনটি অনূদিত চিঠি উপস্থাপন করা হলো।
সিনেটর
স্যাক্সবিকে লেখা ডাক্তার জন রোহেডর একটি চিঠি যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিকতার ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। সমর্থন জুগিয়েছে স্বাধীনতা-সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশকে।
হাডসন,
ওহাইও, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১
মাননীয়
উইলিয়াম বি স্যাক্সবি
নিউ
সিনেট অফিস বিল্ডিং, ওয়াশিংটন ডিসি।
প্রিয়
সিনেটর স্যাক্সবি
দুদিন
আগে আমার স্ত্রী ও আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। ইউএসএআইডির ডাক্তার হিসেবে আমি গত তিন বছর সেখানে কর্মরত ছিলাম। ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলি আপনার জানা আছে, এটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু পুরোপুরি সেন্সরশিপ আরোপ, সাংবাদিকদের বহিষ্কার করা, পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর প্রচারণা এবং দাবিয়ে রাখা—সব মিলিয়ে সেদিনের পর পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছে, সে খবর জানা খুবই কষ্টকর। সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমেরিকার কনসাল জেনারেল এবং তাঁর অধীন কর্মচারীরা সব ঘটনার বাস্তব বিবরণ—ফার্স্ট হ্যান্ড রিপোর্ট পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন।
এসব
প্রতিবেদন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংগ্রহ করা হতো, পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানোর আগে যাচাই করা হতো। পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশ্যে বলছে, তাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কিন্তু প্রতিদিন আমি তথ্যবহুল প্রতিবেদন ঢাকা থেকে পাঠাতে দেখেছি। করাচিতে কর্মরত আমেরিকান কনসাল আমাকে বলেছেন, অতি সম্প্রতি তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের এসব বিবরণ পেতে শুরু করেছেন, অথচ ঢাকা কনস্যুলেট একেবারে শুরু থেকে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে।
যদিও
কনসাল ব্লাডের (আর্চার ব্লাড) প্রতিবেদনে বর্তমান পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে বিবৃত, আমি কতগুলো পর্যবেক্ষণের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ২৫ মার্চ রাতে আমি ও আমার স্ত্রী ছাদের ওপর থেকে মর্টারের গোলার আগুনের লাল শিখায় দেখেছি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক বের হয়ে আসছে। গোলা বর্ষিত হচ্ছে জনাকীর্ণ বস্তি ও বাজারের ওপর। দুদিনের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণের শব্দের মধ্যে যখন কারফিউ ভাঙল, আমরা শহরের ভেতর গাড়ি চালিয়ে এগোতে থাকলাম। যারা শহর ছাড়ছে, তাদের ভিড় ঠেলে গুলশান থেকে মহাখালী আসার পথে দেখলাম, রেললাইনের ধারের ঝুপড়িগুলো আগুনে পোড়া। কাছাকাছি বসবাস করা আমার এক বাঙালি বন্ধু দেখেছেন, সেনাসদস্যরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে আর যখন একটি পরিবার ছুটে বের হয়ে আসছে, তখন তাদের কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছে। আমরা যখন তাকেসহ ১২ জনের পরিবারটিকে আমাদের বাসায় আশ্রয় দিতে চাইলাম, তিনি রাজি হলেন।
পুরনো শহরে আমরা নয়াবাজারে ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলাম। এখানে হিন্দু ও মুসলমান কাঠুরেরা কাজ করতেন। এখন সেখানে কিছু লোহা, পাত ও ধিকিধিকি জ্বলা ধ্বংসাবশেষ। শাঁখারীবাজারের হিন্দু দোকানদার ও কারিগর যারা তখনো বোমার ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে জীবিত, মরিয়া হয়ে আমার কাছে সাহায্য চাইলেন—অভিযানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেনাবাহিনী এলাকার সবাইকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ চালায়। একজনের পেটে গুলি লাগে। আমরা পৌঁছার মাত্র আধঘণ্টা আগে মারা যায়। অন্যরা রাস্তায় পড়ে আছে, পচছে। যেদিন আমাদের ঢাকা ছাড়তে হলো, তার আগের দিন শাঁখারীবাজার গিয়ে