সরকারের ঋণ নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা ও অভিযোগ

ড. আর এম দেবনাথ

সরকারের বিপদ সবদিক থেকেই। ডানে গেলেও বিপদ, বাঁয়ে গেলেও বিপদ, মাঝখানে থাকলেও বিপদ। সবদিকেই সমালোচনা। একজন একদিকের সমালোচনা করলে তা বোধগম্য, কিন্তু সরকার যেদিকেই যাক না কেন, তার সমালোচনা করলে অনেক সময় এর অর্থ বোঝা যায় না। যেমন সরকার ঋণ নিলে সমালোচনা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সমালোচনা, সঞ্চয়পত্র থেকে নিলেও সমালোচনা, বিদেশ থেকে নিলেও সমালোচনা। এতদিন সবাই বলেছে, অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সরকারের ঋণ নেয়া উচিত নয়। কারণ? কারণ বহু। বলা হয় সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি। তাই সরকারের সুদব্যয় বাড়ে, অতত্রব সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র নয়, সরকার যখন সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদিতে বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি সুদ দেয়, তখন কেউ কথা বলেন না। আলোচ্য বিষয়টি বস্তুত আলোচনাতেই নেই। সেখানে সরকারের ফান্ড কত, তার হিসাবও কেউ জানে না। এ প্রসঙ্গ বাদ দিলেও ভিন্নভাবে বলা হয়, ব্যাংকের সমস্যার কথা। সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হলে ব্যাংকের অসুবিধা। ব্যাংকের আমানত (ডিপোজিট) বাড়ে না। লোকজন, সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে আসে না। তারা বেশি সুদের কারণে ব্যাংক থেকে চলে যায়। অতএব ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের কাজ বিঘ্নিত হয়। অথচ কেউ বলে না পাল্টা যুক্তির কথা। সঞ্চয়পত্র দীর্ঘমেয়াদিপ্রডাক্ট বা সরকারি পণ্য। এর তারল্য কম। যখন ইচ্ছা তখন তা ভাঙানো যায় না। আবার চাইলেই সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় না, যত ইচ্ছা তত সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের বিক্রির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করা আছে। একেক ধরনের সঞ্চয়পত্র একেক ধরনের সঞ্চয়কারীর জন্য। যেমন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য এক ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এটি অন্য কেউ কিনতে পারে না। এর ঊর্ধ্বসীমা আছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঊর্ধ্বসীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। পরিবার সঞ্চয়পত্র সংরক্ষিত নারীদের জন্য। এটি করা হয়েছে নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য। পরে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বুড়োদের অনুমতি দেয়া হয়। ৬৫ এবং তদূর্ধ্ব বয়স্করা পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। উভয় ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বতম সীমা আছে। ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড নামীয় সঞ্চয়পত্র শুধু বিদেশে কর্মরত ওয়েজ আর্নারই কিনতে পারেন। অন্য কেউ না। সবচেয়ে বড় কথা, সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক বিনিয়োগের বা ইনভেস্টমেন্টের। এর সম্পর্ক আয়করের সঙ্গে। সরকার আয়কর প্রদান এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য, সঞ্চয়কে উৎসাহিত করার জন্য সঞ্চয়পত্রকে ব্যবহার করে আমানত বা ডিপোজিট নয়। যেমন যেকোনো করদাতা তার মোট আয়ে (সঞ্চয়পত্রের সুদ) বাদে ২৫ শতাংশ সঞ্চয় করতে পারেন; ওই টাকায় সঞ্চয়পত্র কিনলে ১০-১৫ শতাংশ কর রেয়াত পাওয়া যায়। অর্থাৎ সঞ্চয় করলে নির্দিষ্ট পরিমাণ করের বোঝা কমে। কমে মানে ভালো পরিমাণে কমে। সঞ্চয় না করলে, সঞ্চয়পত্র না কিনলে ওই রেয়াত পাওয়া যায় না। পাওয়া যেতে পারে শেয়ার কিনলে। তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন শেয়ার কিনলে। কিন্তু মুশকিল হলো, শেয়ারের কথা শুনলে সবারই গায়ে জ্বর আসে। দু-দুবার শেয়ারবাজার ধস হয়েছে। একশ্রেণীর কোম্পানির মালিক, শেয়ার দালাল শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। তাও আবার অনেক ক্ষেত্রেই আইনি পথে। বেআইনিভাবে হলেও আজ পর্যন্ত কোনো বিচার-আচার হয়নি। ওদিকে ব্যাংকারদের যুক্তি বাস্তবতাবর্জিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সঞ্চয়পত্র বিক্রি হলে ওই টাকা সরকারের হিসাবে জমা হয়। সরকার দৈনন্দিন ভিত্তিতে ওই টাকা খরচ করে। তা সহসাই বাজারে যায়বেসরকারি খাত তা পায়। অর্থাৎ এ প্রক্রিয়া এক ধরনেরআমানত অন্য ধরনে রূপান্তর হয় মাত্র। সরকারিআমানত বেসরকারি আমানত হয়, বেসরকারি আমানত সরকারি আমানত হয়। এতে মোট আমানতের কিছুই যায় আসে না। এই যে কথার পীঠে কথা তার কথা কেউ বলে না। উল্টো বরং বলা হয় সঞ্চয়পত্র কেনায় অনিয়ম হচ্ছে। ধনীরা সঞ্চয়পত্র কিনছে, ঊর্ধ্বসীমার বাইরে অনেকে সঞ্চয়পত্র কিনছে। অনেকে বাসাবাড়ি, চাকর-বাকরের নামে সঞ্চয়পত্র কিনছে। এসব অভিযোগের ভিত্তি কী? ঊর্ধ্বসীমার বাইরে কেনার সুযোগ কোথায়? কেউ যদি কিনেও থাকে, সে সুদ পাবে না বলে তার অঙ্গীকারনামা ফরমে দেয়া আছে। এর পরও তা সত্য হলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া খুবই সহজ। মানুষ টাকা-পয়সা দিয়ে কাউকে বিশ্বাস করে বলে কি কারো মনে হয়? বাস্তবতা কী বলে? বাসাবাড়ির চাকর বা আত্মীয়স্বজনের নামে টাকা রেখে কি কেউ নিরাপদ বোধ করে? বিষয়টি এত সহজ নয়। এটা অতিসরলীকৃত ধারণা। সবচেয়ে মারাত্মক কথা বলেছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ। বলেছেন, সঞ্চয় করে অলস ব্যক্তিরা। অবসর নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে যারা খেতে চায়, তারাই সঞ্চয়পত্র কেনে। এ ধারণা যে কত ভুল, কত মারাত্মক তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না। এখানে যে রাষ্ট্র আমেরিকার মতো নাগরিকের দায়িত্ব নেয় না, এ কথা তারা ভুলে যায়।

এই যে কথার পিঠে কথাগুলো বললাম, তা অনেকে আমলে নেননি। না নিয়ে সরকারকে বাধ্য করলেন সঞ্চয়পত্র নিরুৎসাহিত করতে। সরকার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমাল না। বুদ্ধি করে করল কী, সঞ্চয়পত্রে অর্জিত সুদের ওপর ৫ শতাংশের স্থলে ১০ শতাংশ কর বাধ্য করল। সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে ব্যাংক এখন টিআইএন চায়। আয়ের উৎস কী তাও জানতে চায়। নানা কড়াকড়ির গ্যাঁড়াকলে এখন সঞ্চয়পত্র। অতএব সরকার যাচ্ছে এখন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণে। কারণ সরকারের টাকা দরকার।


এখন বিপদ অন্যত্র। এখন চারদিকে কথা, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ফলে বেসরকারি খাত ঋণ পাচ্ছে না। সরকারের টাকা দরকার। রাজস্ব আদায় ঠিকমতো হচ্ছে না। অতএব প্রায় বছরের চাহিদার সমান ব্যাংকঋণ চার-পাঁচ মাসেই সরকার নিয়ে ফেলেছে। এতে হয়েছে কী? এখন বলা হচ্ছে সরকার বেশি বেশি ঋণ নেয়ার ফলে বেসরকারি খাত ঋণ পাচ্ছে না। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। এখনকার অভিযোগ প্রতিদিন ফলাও করে বলা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের পছন্দের বিষয় এটি। বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা দরকার; প্রথম কথা হলো সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঋণ নেয় সরকারি ব্যাংক থেকে। সেখানে সুদের হারও কম। বেসরকারি ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়ার উদাহরণ কম। বেসরকারি খাতে এ কারণে ঋণপ্রবাহ কমেছে এই কথা কতটুকু ঠিক? বেসরকারি ঋণের সিংহভাগ জোগান দেয় বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আমানত ও ঋণের সিংহভাগ বাজার এখন বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে। তাহলে সমস্যাটা সরকারি ব্যাংকের নয়। বাজারে তাদের সম্পদ এখন কম। সরকারি ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয় যেমন বাধ্য হয়ে, তেমনি আরেকটি কারণও আছে। সরকারকে ঋণ দিলে তা খেলাপি হয় না। ব্যাংকগুলো বেঁচে যায়, প্রভিশন করার হাত থেকে বেঁচে যায়। এছাড়া আরেকটি কারণও আছে। সরকার ঋণ নেয় বড় পরিমাণের। এসব ঋণ বেসরকারি ব্যাংক একটা-দুটো-তিনটা মিলেও দিতে পারে না। উভয় পক্ষের সুবিধার্থে সরকারি ঋণ সরকারি ব্যাংক থেকে নেয়া হয়। বেসরকারি ঋণ বাড়ছে না বলে যে অভিযোগ, তাহলে এর উত্তর কী? প্রথম কথা হলো, সরকার যখন ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে পাবলিকের কাছ থেকে ঋণ নিত, তখনই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কম ছিল। বস্তুত দু-তিন বছর যাবৎই এ ঘটনা, অথচ সরকার ব্যাংক থেকে বেশি বেশি ঋণ নিচ্ছে এ অর্থবছর (২০১৯-২০) থেকে। এখানে আরো একটি কারণ বিদ্যমান। অনেক বেসরকারি ব্যাংক বহু আগেই অনেক বেশি ঋণ দিয়ে এখন বিপদে আছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ঊর্ধ্বসীমার বাইরে ঋণ দিয়েছে, যা বস্তুতপক্ষে শাস্তিযোগ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শাস্তির ব্যবস্থা না করে বরং তাদের বলেছে, ঋণের পরিমাণ অ্যাডজাস্ট করতে, অর্থাৎ সমন্বয় করতে। সমন্বয় করতে হলে নতুন নতুন আমানত লাগে। বাজারে আমানতের টানাটানি চলছে। কম সুদে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। এখন যদি ৬-৭ শতাংশে আমানত কেউ চায়, তাহলে আমানতকারীরা আমানত দেবে কেন? সবচেয়ে বড় কথা মানুষের আয়ে টান পড়েছে। ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদ কম। সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় না। নতুন চাকরি নেই। পুরনো চাকরি যাচ্ছে। প্রতিদিন শত শত লোক চাকরি হারাচ্ছে। অনেক বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এটা শীতকাল। এখন খেয়ে-পরে আরামে থাকার কথা। চাল উঠছে, অথচ দাম ঊর্ধ্বমুখী। শাকসবজি, মাছ-মাংসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। অথচ এ ভর শীতকালে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে সবজির দাম থাকে সবচেয়ে কম। একটা ভালো ফুলকপি এখনো ৪০-৫০ টাকা। পেঁয়াজের দাম এখনো কমছে না। ডাল, সয়াবিন তেল, রসুন ইত্যাদির দাম বেড়েছে। মাঝখানে লবণের ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের পকেট কাটল। অর্থাৎ আয় স্থবির অথবা কম হওয়া সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। মানুষ সঞ্চয় করবে কোত্থেকে? মানুষের আয় যে কম, তার একটা লক্ষণ হচ্ছে কর বা ট্যাক্স পরিস্থিতি। কর আদায় কম হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। রেমিট্যান্স বাদে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণেই ফান্ডের অভাব, ব্যাংকগুলো আমানত পাচ্ছে কম। এখন ধৈর্য ধরার সময়। ব্যাংকগুলো কেন বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে পারছে না, তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা দরকার। উদ্যোক্তারা কি বাইরে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী, বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো কি সংকুচিত হয়ে এসেছে, ভারতীয় অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কি আমাদের ওপর পড়েছে, ব্যবসায়ীরা কিওয়েট অ্যান্ড সি নীতি নিয়েছেনএসব কারণও খতিয়ে দেখা দরকার। নানা ধরনের সমালোচনা, শাস্তি ও মামলার কারণে ব্যাংকাররা কি ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করছেএ বিষয়টিও বিচার করে দেখা দরকার।

 

. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন