ওষুধ শিল্পের দূষিত বর্জ্য

ব্যবস্থাপনায় উত্তম চর্চার পরিপালন নিশ্চিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারি বাড়ুক

দেশে ওষুধ শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়ন আশাজাগানিয়া হলেও এর দূষিত বর্জ্য ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। এ শিল্পের কারখানাগুলোর উৎপাদন কার্যক্রমে ব্যবহূত বিভিন্ন ভারী ধাতু ও বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য অব্যাহতভাবে দূষণ করে চলেছে মাটি ও প্রাণ-প্রতিবেশ। রাসায়নিক বর্জ্যের অবশিষ্টাংশ ঢুকে পড়ছে খাদ্যশৃঙ্খলে। ফলে বাড়ছে ক্যান্সারসহ নানা মরণঘাতী ব্যাধিতে আক্রান্তের হার, সার্বিকভাবে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। কিন্তু হতাশাজনক বিষয় হলো, এর বিপরীতে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ঘাটতি প্রবল। অনেক কারখানারই নেই সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া। উন্নত দেশগুলোয় এটি অকল্পনীয় ব্যাপার। দেশে ওষুধসহ সব শিল্প-কারখানার দূষণ রোধে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) ব্যবহারের বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট আইনে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক। অথচ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কারখানায় নামমাত্র ইটিপি স্থাপন করা হলেও উচ্চব্যয়ের অজুহাতে অনেক ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয় না বলা চলে। তদুপরি নেই নিজস্ব অন্য বর্জ্য রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা। এতে রাসায়নিক দূষণ প্রতিরোধ দূরে থাক, সময়ান্তরে এর মাত্রা বরং বাড়ছে। এটি অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। বড় বিপর্যয় এড়াতে প্রতিটি ওষুধ কারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের উত্তম চর্চাগুলোর পরিপালন নিশ্চিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারি বাড়াতে হবে।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের সুবাদে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকা জিএসকের চট্টগ্রামের কারখানার বর্জ্যদূষণ ও তেজস্ক্রিয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী কারখানাটির দূষিত বর্জ্যের দূষণক্ষমতা ও তেজস্ক্রিয়া পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হতে সময় লাগবে ৬০ বছরেরও বেশি। সাংঘাতিক উদ্বেগজনক তথ্য বৈকি। এটি একটি ঘটনামাত্র। বিভিন্ন ওষুধ কারখানার উৎপাদনযজ্ঞে প্রতিনিয়তই নানা রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার হচ্ছে। এসব উপাদানের বর্জ্য বা অবশিষ্টাংশ যথাযথভাবে পরিশোধন ও সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে কিনা, সেটি বরাবরই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছুটা সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। কারখানা পরিদর্শনপূর্বক আর্থিক জরিমানার কিছু খবর গণমাধ্যমে আসে। তারপর তথৈবচ। অভিযান থিতিয়ে পড়ে। অব্যাহত থাকে দূষণ। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। রাসায়নিক দূষণ প্রতিরোধ করতে হলে তা উৎস পর্যায়েই করতে হবে। কারখানাই এর প্রাথমিক উৎস। কাজেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে কারখানা পর্যায়েই নজরদারি বাড়াতে হবে। নিয়মের ব্যত্যয়ে কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে নিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাকে হতে হবে আরো সক্রিয়।

শুধু সরকার তথা পরিবেশ অধিদপ্তর আন্তরিক ও সক্রিয় হলে হবে না, দূষণ রোধে ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। দেখা যায়, যারা শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন, তাদের অনেকেই ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে নিশ্চিত করেন না। ফলে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। বর্জ্যজনিত দূষণ রোধ করতে হলে শিল্প মালিকদের এ মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। আজকাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সর্বসাম্প্রতিক প্রযুক্তি রয়েছে, আছে উন্নত ও আধুনিক রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি। প্রাথমিকভাবে এর বিনিয়োগ ব্যয় কিছুটা বেশি হলেও চূড়ান্তভাবে এটি ওষুধ শিল্পের জন্য সুফল প্রদায়ী। এ ধরনের প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহারে শিল্প মালিকদের উৎসাহিত হওয়া দরকার। এতে দূষণ অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ওষুধ শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ইস্যুটি জটিল। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ ওষুধ শিল্পে এগিয়ে থাকা পশ্চিমা দেশগুলো কীভাবে এ খাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করছে, তার অভিজ্ঞতা বিনিময় করা যেতে পারে; তাদের গৃহীত উত্তম চর্চাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। সন্দেহাতীতভাবে এতে আমাদের ওষুধ শিল্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়বে। দূষণ ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত একটি চর্চা হলো পলিউটার্স পে প্রিন্সিপল। এ নীতি অনুযায়ী, দূষণকারীকেই দূষণজনিত মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি প্রতিরোধের ব্যয় বহন করতে হবে। বাংলাদেশেও এটি অনুসরিত হতে পারে। এতে দূষণকারীরা নিরুৎসাহিত হবে বৈকি। তবে এ নীতি  সর্বরোগহরকর নয়। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি অবশ্যই প্রয়োজন। পরিবেশ অধিদপ্তরকেই কাজটি করতে হবে। সংস্থাটিকে নিয়মিত বিরতিতে ওষুধ কারখানাগুলোয় অভিযান চালাতে হবে, যাতে কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে উদ্যোগী হয়। যারা ব্যবস্থাপনা কমপ্লায়েন্স লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে শুধু আর্থিক জরিমানা নয়, কারখানা বন্ধের মতো কঠোর ব্যবস্থাও নিতে হবে। দায়িত্বশীল সংস্থার তদারকি ও শিল্পোদ্যোক্তাদের আন্তরিকতার সম্মিলনে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ওষুধ শিল্প গড়ে তোলা মোটেই অসম্ভব নয়।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন