রোমাঞ্চ মোড়ানো সিকিম

আহমেদ রিয়াদ

সমতলে বসবাসরত মানুষের কাছে পাহাড় আর বরফ সবসময় কাঙ্ক্ষিত এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ছোটবেলা থেকেই মনে রোমাঞ্চ কাজ করতকবে দেখতে পাব পাহাড় ও বরফসন্ধি? মনের সে চাওয়াই শেষমেশ পূরণ হলো চলতি বছর। অক্টোবরে পাহাড় ও বরফের অপরূপ সন্ধি দেখতে যাওয়ার সুযোগ হলো ভারতের সবচেয়ে উত্তরের পর্যটনখ্যাত জনপদ সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে। সিকিম শহরের গ্যাংটক নামটির সঠিক অর্থ জানা যায়নি। যদিও লোকমুখে এগ্যাংটক নামটির জনপ্রিয় অর্থ হলোপাহাড়চূড়া

অনন্য সৌন্দর্যে মোড়ানো ভারতের পর্যটনসমৃদ্ধ রাজ্যটি। বছরজুড়েই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণপিয়াসী পর্যটকদের আনাগোনা থাকে রাজ্যজুড়ে। এবার আমাদের ভ্রমণ যাত্রা কেবল গ্যাংটক শহরেই আটকে থাকেনি। ঘুরে এসেছি গ্যাংটকের সবচেয়ে উত্তরের জনপদ জিরোপয়েন্ট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যেটি ১৫ হাজার ৩০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত।

পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ছয়জনের দল রওনা হই। যাত্রার প্রথমদিন সকালে আমাদের বাংলাদেশ অংশে লালমনিরহাটে অবস্থিত বুড়িমারী সীমান্তে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পর্ব শেষ করে ভারতীয় অংশে চ্যাংরাবান্দা পোর্টেও একই কাজ সম্পন্ন করি। ইমিগ্রেশন শেষে ছোট্ট একটি ট্যাক্সিতে আড়াই ঘণ্টায় চলে আসি শিলিগুড়ি শহরের এসএনটি বাস স্টেশনে। এসএনটি মানে সিকিম ন্যাশনালাইজড ট্রান্সপোর্টেশন। সিকিমে যেতে হলে এখান থেকে অনুমতি ও গাড়ি ভাড়া নিতে হয় আগন্তুকদের। এখান থেকে মাহিন্দ্রা জিপ নিয়ে রওনা হলাম। শিলিগুড়ি শহর শেষ হতেই হঠাৎ শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য তেমন একটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মাঝে মধ্যেই দেখা মিলছিল ভারত অংশে তিস্তা নদীর উজানের অংশ।


ঘণ্টা তিনের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম রংপোতে। জিপ থেকে নেমে দেখি প্রবেশমুখে তালা। ক্ষণিকের জন্য অনুমতি না পাওয়া-পাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ওই সময় কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম আমরা সবাই। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে যে আমাদের স্বদেশী এক ভাইয়ের সহায়তা নিয়ে আমরা শেষ মুহূর্তে সিকিম যাওয়ার অনুমতি পাই। এরপর আমরা রংপো থেকে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের উদ্দেশে যাত্রা করি। দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে পৌঁছে যাই। রাতে সিকিমের যাত্রাপথে পাহাড়ের কোলঘেঁষে বানানো স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছিল পাহাড়ের কালো জোনাকি পোকার আনাগোনা, যা আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আদতে এগুলো ছিল কালিমপং ও সিকিম রাজ্যের গ্রামের ঘরবাড়ির লাইটের আলো। রাত ১০টায় আমরা গ্যাংটকের এমজি মার্গে পৌঁছলাম। কিন্তু আগে থেকে হোটেল বুকিং ছিল না। তাই কিছুটা ঘোরাঘুরি করে এমজি মার্গ থেকে কিছুটা উপরে একটি বড় রুম নিলাম। রাতেই আমরা একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে আলোচনা করে এক রাত দুইদিনের জন্য লাচুংয়ের ইয়ানথাম ভ্যালি ও জিরোপয়েন্ট যাওয়ার জন্য ১৭ হাজার রুপিতে প্যাকেজ নিলাম।


পরদিন বেলা ১১টায় গ্যাংটকের স্থানীয় বাজরা জিপ স্টেশন থেকে আমরা রওনা হলাম লাচুংয়ের উদ্দেশে। চলতি পথে দুই ধারে সারাক্ষণ আমরা দেখছিলাম হিমালয় পর্বতমালার সুউচ্চ শিখরগুলোর মাঝখানে মনোরম পরিবেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাম না জানা অসংখ্য সুউচ্চ পাহাড়। ৬ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমাদের রাতে থাকার জায়গায় এসে পড়ি লাচুং গ্রামে। গ্রামটি বেশ ছোট। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বরফ গলা পানির প্রবহমান। বয়ে যাওয়া এ নদীর নাম স্থানীয়ভাবে লাচুং নদী। এ নদীই মূলত উজান থেকে ভাটিতে গিয়ে মিশেছে তিস্তা নদীতে।

আমরা যে হোটেলটিতে রাত্রিযাপন করলাম, সেটি পাহাড় কেটে তৈরি করা। রুম থেকে বেরিয়ে বেলকনির সামনে আসতেই দেখা গেল মেঘ আর তুষার মোড়ানো নাম না জানা পাহাড়। কী অপরূপ দৃশ্য! রাতেই এক পসলা বৃষ্টি হয়েছে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল পাহাড়ের কোলঘেঁষে মুড়িয়ে থাকা শুভ্র মেঘদের। কোনো রকম রাত কাটিয়ে ভোরেই আমরা জিপ নিয়ে রওনা হই ইয়ামথাং ভ্যালি হয়ে জিরোপয়েন্টে। উদ্দেশ্য সূর্যোদয় দেখব। কিন্তু অধিক বৃষ্টিপাতে আমাদের যাত্রাপথটা বিলম্ব হলো। তার পরও দুই পাশের অনন্য সুন্দর পাহাড় ও গাছপালা এবং নাম-না জানা ঝরনা দেখে সকাল ৮টার মধ্যে জিরোপয়েন্টে পৌঁছে গেলাম।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জিরোপয়েন্টের উচ্চতা ১৫ হাজার ৫০৩ ফুট। এমন উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের দলের কয়েকজন সদস্যের শ্বাস নিতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। তাই আমরা সেখানে বেশি সময় থাকতে পারলাম না। মিনিট ত্রিশের মতো কাটিয়ে দূরের বরফে আচ্ছাদিত পাহাড় ও শ্বেতশুভ্র বরফ খণ্ড দেখে আমরা ফিরে এলাম। এ অঞ্চলে বরফ বেশি পাওয়া যায় অক্টোবরের শেষ ভাগে। আমরা গিয়েছিলাম অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। পাহাড়ের গায়ে বরফ তাই ছিল সামান্যই। তবে কিছুটা দূর পাহাড়ে বরফ জমার দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

ফেরার পথে এবার আমরা লাচুং গ্রামের আগে ইয়ামথাং ভ্যালিতে কিছুটা সময় যাত্রা বিরতি দিলাম। পাশের লাচুং নদীতে পানির ঢল নামছে ভাটিতে। নদীর ওপর পারে সুউচ্চ পাহাড় থেকে বড় বড় গাছের সাড়ি নেমে গেছে নদীর পাদদেশে। এ দৃশ্য আসলে অন্য রকম। সেখানে ১ ঘণ্টার মতো যাত্রাবিরতি শেষে আমরা ৬ ঘণ্টার মতো ভ্রমণ করে রাতে গ্যাংটক পৌঁছাই। সকালে গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি হয়ে চ্যাংরাবান্দা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের মধ্য দিয়ে আমাদেরও সিকিম ভ্রমণ শেষ হয়। সঙ্গে ছিল কেবল রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন