টাঙ্গাইল সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে
লৌহজং নদীর তীরে নান্দনিক সৌন্দর্যের পাকুটিয়া জমিদার বাড়িটির অবস্থান। প্রতিটি
অট্টালিকার মাঝ বরাবর লতাপাতা ও ফুলের অলংকরণে কারুকার্যমণ্ডিত দুই নারীর মূর্তি
রয়েছে
ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় ২টা ৪০ মিনিট।
বাদামতলী বিলাসের সদর দরজায় এসে হাজির। কি আর করা, রিজিকে যা ছিল দুপুরে, তা-ই খেল সে
আমাদের বাড়িতে। খেতে খেতে বলল,
চলেন ভাইয়া পাকুটিয়া যাই। এই অবেলায়, এখন
বাজে প্রায় সোয়া ৩টা। প্রিন্স জানাল,
না ভাইয়া বেশি সময় লাগবে না। আচ্ছা চলো। দরকার
হলে সারা রাত ঘুরব।
তার বাইক রেখে ছুটলাম আমার সদ্য কেনা
এভেঞ্জার নিয়ে। তবে চালকের আসনে সে। নয়া বাইকের রাইডার হতে পেরে সে বেশ উত্ফুল্ল।
ঢাকা-আরিচা
মহাসড়কের নবীনগর পার হতেই কালামপুরের বাসন্দা দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের এক বন্ধুকে সেলফোনে
নক করি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই কালামপুর। সময়স্বল্পতায় কালামপুরের বিখ্যাত
শুকনো মিষ্টি না খেয়েই ছুটলাম। সড়কের দুই পাশে দেখা বাংলার মুখরিত নান্দনিক রূপ-লাবণ্য মুগ্ধ
করছে। বিস্তৃত ফসলের মাঠ, হলদে রাঙা সরিষা ফুলের ঘ্রাণ,
তারপাশ দিয়ে বাইক চলছে। ঢাকা-মানিকগঞ্জ-টাঙ্গাইল এ তিন
জেলার মিলনস্থল দ্বিমুখা বাজারের গরম পেঁয়াজু আর গরুর দুধের চা, আহ্!
আরো কিছুটা পথ যেতেই পশ্চিম আকাশে সূর্যটা প্রায় ডুবতে বসল। পথের পাশের আবাদি
জমিনের নানা সবজি-ফুলের ঘ্রাণ পেতে পেতেই একেবারে শেষ বেলায় পৌঁছে গেলাম পাকুটিয়া জমিদার
বাড়ির আঙিনায়। প্রথম দেখাতেই বেশ ভালো লেগে গেল। আলো থাকতে থাকতে আমরা বেশ কয়েকটা
ছবি তুলে নিই।
মাগরিবের আজান পড়লে নামাজ শেষে আবারো
ফিরে আসি জমিদারের রেখে যাওয়া বাড়িটিতে। ওমা একি! পুরো বাড়িতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছোট্ট
একটা বাতি জ্বলে, তাও মিটি মিটি। অথচ একদা এ বাড়ির জমিদারদের ছিল কত শৌর্যবীর্য। প্রধান
ফটকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশাল সাইনবোর্ডসহ মূল বাড়ির দেয়ালেও ঝুলছে বোর্ড-ব্যানার।
কিন্তু একি হাল! জমিদার বাড়িটি বর্তমান টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় অবস্থিত। এ
নাগরপুরকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশের শেষ দিকে ও পাকিস্তান আমলের অনেকটা সময় কলকাতা
থেকে বাণিজ্যিক ও যাত্রীবাহী স্টিমারের চলাচল ছিল। গড়ে উঠেছিল কলকাতার সঙ্গে
নাগরপুরের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। পরবর্তীতে পশ্চিম কলকাতার ধনাট্য
ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল নাগরপুরে আসেন। তিনি উনিশ শতকের শুরুতে পাকুটিয়ায়
জমিদারি শুরু করেন।
প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে তিনি একই
নকশার পরপর তিনটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন। এ রকম স্থাপনার জন্য বাড়িটি তখন ‘তিন
মহলা’
নামেও পরিচিত ছিল। টাঙ্গাইল সদর থেকে ৩৫
কিলোমিটার দূরে লৌহজং নদীর তীরে নান্দনিক সৌন্দর্যের পাকুটিয়া জমিদার বাড়িটির
অবস্থান। প্রতিটা অট্টালিকার মাঝ বরাবর লতাপাতা ও ফুলের অলংকরণে কারুকার্যমণ্ডিত
দুই সুন্দরী নারীর মূর্তি রয়েছে। প্রত্যেকটা ভবনেই রয়েছে নিজস্ব কারুকার্য
শোভামণ্ডিত সৌন্দর্য। বারান্দার রেলিংগুলোতে রয়েছে অসংখ্য ছোট নারী মূর্তি।
অট্টালিকাগুলো পাশ্চাত্য শীল্প-সংস্কৃতির অনন্য সৃষ্টি। এর নির্মাণ ধাঁচ পর্যটকদের বেশ বিমোহিত করে।
শত বছর পরও এখনো রয়েছে নাট মন্দির। দ্বীতল বাড়িটির সামনে রয়েছে বিশাল মাঠ। আরো
রয়েছে উপেন্দ্র সরোবর নামে দৃষ্টিনন্দন আটঘাটলা পুকুর। অন্ধকার নেমে আসায় যদিও
পুকুরটা আমার দেখা হয়নি; তবু যা শুনেছি তাতেই বেশ অনুমেয়। সেই ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি জমিদার
বাড়িটির নান্দনিক সৌন্দর্য এখনো পর্যটকদের কাছে টানে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে বেশ উদাসীনই মনে হলো।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে
নাগরপুর পর্যন্ত এসবি লিংক পরিবহনের বাস চলাচল করে।
ভাড়া: ৭৫ টাকা।
ছবি: দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম