২০০৮ সালের অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক
সংকট, এর পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া মন্দা পরিস্থিতি, অর্থনীতির
পুনরুদ্ধারে প্রচলিত মুদ্রা ও আর্থিক নীতির ব্যর্থতা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের যে ধস
আমরা প্রত্যক্ষ করছি, এর সবই প্রচলিত অর্থনীতি সম্পর্কে বৃহৎ পরিসরে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
রবার্ট সিডেলিস্কির ‘মানি অ্যান্ড গভর্নমেন্ট;
দ্য পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার অব ইকোনমিকস’ নামের নতুন
বইয়ের পর্যালোচনায় ডেভিড গ্রেইবার যেমন বলেছেন, ‘অনুভূতিটি
কেবলই প্রকট হচ্ছে...যে অর্থনীতির শৃঙ্খলাগুলো আর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
নির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা বা সমাধান
তুলে ধরার পরিবর্তে আজ আমি অর্থনীতির মূল্যায়ন সম্পর্কিত কয়েকটি মূল বিষয়ের প্রতি
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। অর্থনীতির শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে মূল্যায়নের দিকটি
বিষয়গতভাবেই সহজাত, যা বিজ্ঞান ও বোধের একটি অদ্ভুত মিশ্রণ। রাজনীতিবিদের বিভিন্ন নীতিগত
ভুলের কারণ এটাই যে তারা নিজেদের কাণ্ডজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেন।
এক্ষেত্রে অন্য যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়
তা হলো, অর্থনীতিবিদরা যা বলেন,
তা তাদের গবেষণাকে প্রভাবিত করতে পারে। আর তা
প্রকৃতিবিজ্ঞান থেকে আলাদা। এছাড়া আরোপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে যেকোনো
অর্থনীতিবিদই এ পর্যন্ত শেয়ারবাজার ধস বা বিনিময় হারের ওঠানামা সম্পর্কিত কোনো
ভবিষ্যদ্বাণী করতে সমর্থ হননি। ধরে নেয়া যাক,
এমন একজন নারী অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। তিনি যদি পূর্বাভাস
দেন যে আগামী মাসে শেয়ারবাজারে ধস হবে। এতে ফলাফল যা দাঁড়াবে তা হলো, রাতারাতি
শেয়ারবাজারে ধস নামবে। আগামী মাস পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা তার
কথার পরিপ্রেক্ষিতে লোকেরা যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেবে।
এদিকে আবার শেয়ারবাজার ধসের প্রকৃত
কারণ হয়ে উঠবে ওই অর্থনীতিবিদের পূর্বানুমানটি। তাই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে একজন
অর্থনীতিবিদের পক্ষে বাজার ধস সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান কিংবা এ-বিষয়ক ক্ষমতা
প্রদর্শনের বিষয়টি যৌক্তিকভাবেই অসম্ভব। তবুও স্বীকার করতে হবে যে গতানুগতিক
অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান আমাদের নতুন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো, প্রযুক্তি
বিপ্লব, অস্থির বাজার, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন এবং গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ মোকাবেলায় সাহায্য
করার ক্ষেত্রে খুব একটা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
অস্বীকারের উপায় নেই যে বাস্তবতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক কার্যক্রম অর্থনীতিকে আজকের এ গুরুত্বপূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। একইভাবে সময় এসেছে অর্থনৈতিক তত্ত্বের দিকে ফিরে তাকানোর। যদিও রুগ্ণ অর্থনীতি ও চূর্ণবিচূর্ণ রাজনীতি শৃঙ্খলার ভিত্তি সম্পর্কে বড় রকমের প্রশ্নের জন্ম দেয়। অর্থনৈতিক তত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে মহাবিশৃঙ্খলার সময়গুলোয়—এক্ষেত্রে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি বিভিন্ন জায়গায় লিখেছি; শিল্প বিপ্লবের সময়ে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ স্ট্যানলি জেভনস চূড়ান্তভাবে তুলে ধরেন যে কীভাবে দাম নির্ধারণ পদ্ধতি গঠিত হয় এবং পণ্য ও পরিষেবাগুলো কীভাবে মূল্য অর্জন করে। ১৮৬০ সালে এক চিঠিতে তিনি তার সহোদরকে লেখেন, ‘ওই বিষয়ের ওপর কোনো বই পড়তে শুরু করলে আমার এখন বিরক্তি ধরে যায়।’ সময়টি ছিল প্রান্তিক বিপ্লবের সূচনাকাল, পরবর্তী সময়ে লিওন ওয়ালরাস ও অন্য অনুসারীরা এক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম হন।
মহামন্দার দশক ও পরবর্তী সময় ছিল
যুগান্তকারী। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট সলো ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে তার
স্কুলজীবনের কথা স্মরণ করে লিখেছেন,
‘আমাদের সমাজ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল এবং আমরা কেউই জানতাম না, এগুলো
কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কিংবা এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী।’ তাই এটি কোনো
কাকতালীয় ঘটনা নয় যে মহামন্দার সময় ঘিরে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, যেমন
জন মিনার্ড কেইন্সের দ্য জেনারেল থিওরি অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট
অ্যান্ড মানি (১৯৩৬) ও জন হাইকসের ভ্যালু অ্যান্ড ক্যাপিটাল (১৯৩৯)।
‘আমরা অনুরূপ একটি সময়ের মধ্যে বাস করছি’—রবার্ট সলোর এ উক্তি ১৯৩০-এর দশকের
মতো বর্তমান বিশ্বের জন্য এখনো প্রাসঙ্গিক। তবে একমাত্র পার্থক্যটি হচ্ছে, আমাদের
বর্তমান পৃথিবী অনেক বেশি বিশ্বায়িত। তাই অর্থনৈতিক অস্থিরতা শুধু আমেরিকা কিংবা
উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা
ও এশিয়ায় বিস্তার লাভ করবে।
বিজ্ঞান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কাজ
করলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনের ডাক দেয়। অর্থনীতিসহ বিজ্ঞানের
সব বিষয়ই অনুমানের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে অনেকগুলোই স্পষ্ট বা প্রায়ই
স্বতঃসিদ্ধভাবে লেখা হয়েছে। বিজ্ঞানের সব শাখাই অনুমানের ওপর নির্ভর করে, তাছাড়া
এটা এতটাই গভীরভাবে সংযুক্ত যে,
চর্চাকারীরাও এগুলো নিয়ে সতর্ক নন। তাই বোধকরি
এগুলো বলা হয়, ‘অপ্রীতিকর কাজ’—বিষয়টি আমি আমার
‘বিয়ন্ড দি ইনভিজিবল হ্যান্ড’ শীর্ষক বইয়ে
তুলে ধরেছি।
যদিও রোজকার জীবনে আপনি এর উপস্থিতি
দেখতে পাবেন। ধরুন, আপনি কোথাও নৈশভোজে গেছেন,
আমন্ত্রণকারী ব্যক্তি আপনার কাছে জানতে চাইল, আপনি
কি সব ধরনের খাবার খান? আপনি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন এটা অনুমান করে যে গাছের ডালপালা আর পাথর নিশ্চয়ই
খাবারের অংশ নয়। তবে আন্তঃসাংস্কৃতিক দাওয়াত খেতে গিয়ে আপনার সুপ্ত অনুমানগুলোর
ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিলে কিন্তু বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারেন। ইউক্লিডীয়
জ্যামিতির বিকাশ হয়েছিল স্পষ্টতই উপপাদ্যের একটি সিরিজ লেখার মধ্য দিয়ে। কোথাও
উল্লেখ না থাকলেও ইউক্লিডিয়ান দৃষ্টান্তের মূলে ছিল একটি সমতল ও আনুভূমিক
পৃষ্ঠতলের অনুমান। তার পরও ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি গোটা মহাবিশ্বের জন্য জোরালোভাবে
প্রয়োগ করা যাবে না, বিশেষ করে আমাদের এই গোলাকার পৃথিবীতে, যেখানে আমরা বাস করি। সুইস
গণিতশাস্ত্রবিদ লেওনহার্ড ইউলার অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিষয়টি আনুধাবন করতে পারেন এবং
নন-ইউক্লিডিয়ান
জ্যামিতির মৌলিক পরিবর্তন করতে শুরু করেন
(এটা অবশ্যই ঠিক যে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি কারো
একার অর্জন নয়, তবে এখন পর্যন্ত এটি তার বিস্ময়কর কৃতিত্ব)।
বর্তমানে আমরা অর্থনীতিবিদরা এমন একটি
পর্যায়ে অবস্থান করছি, যেখানে আমাদের অনুমানগুলো পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখা দরকার। বিশেষ করে
ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং আন্তঃসংযোগের যে নতুন বিশ্বে আমাদের বসবাস, এটি
সম্পর্কে অনুধাবন ও বিস্তারিত বর্ণনার ক্ষেত্রে কোন দিকগুলো আমাদের বোঝার
সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এক্ষেত্রে
‘সাধারণ বিজ্ঞান’-এর কাজগুলো চালিয়ে যেতে হবে, কিন্তু
শৃঙ্খলার তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো পরীক্ষা করার সময় এসেছে।
আর এ বিষয়গুলো বুঝতে হলে আমাদের
পরিসংখ্যানগত নিয়মের বাইরে যেতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, অর্থের দুনিয়া কীভাবে পণ্য ও
পরিষেবাদির সরবরাহকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে আমাদের খুঁজে দেখতে হবে অর্থনীতি
কীভাবে আমাদের রাজনৈতিক পছন্দগুলোকে প্রভাবিত করে এবং পরবর্তী সময়ে তা অর্থনীতিতে
কী ধরনের অভিঘাত হয়ে আসে। এছাড়া আমাদের উপলব্ধি করা জরুরি যে অর্থনৈতিক আচরণ শুধু
মূল্য ও নিয়ন্ত্রণ দ্বারা গঠিত হয় না,
বরং আমাদের মননে বোনা সামাজিক রীতিনীতি দ্বারাও
নির্ধারিত হয় এবং আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দগুলোকে প্রভাবিত করে। আর এ পছন্দগুলোর
মাধ্যমেই আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও সামগ্রিক বিশ্বের কল্যাণ সাধিত হয়।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]
কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের
সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ
কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক
ভাষান্তর: রুহিনা
ফেরদৌস