প্রতিটি পেশারই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য
রয়েছে। এ কারণে দায়িত্ব ও কর্তব্যও ভিন্ন। যদি কোনো খাত চ্যালেঞ্জ বা সংকট
মোকাবেলার মধ্যে থাকে, তবে তার প্রভাব কর্মীদের ওপরও পড়ে। দেশের সঙ্গিন আর্থিক খাতের প্রভাব
ব্যাংকারদের ওপরও পড়েছে। এ কারণে তারা বাড়তি চাপের মধ্যে রয়েছেন খেলাপি ঋণ আদায়
থেকে আমানত সংগ্রহ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব
ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় বলা হয়েছে,
এক-তৃতীয়াংশের বেশি ব্যাংক কর্মী তীব্র মানসিক চাপে ভোগেন। এ প্রভাব গিয়ে
পড়ছে তাদের কাজেও। বেশকিছু কারণে চাপে ভোগেন ব্যাংক কর্মীরা। এর মধ্যে চাকরির
অনিরাপত্তা, ঊর্ধ্বতনের বাড়তি চাপ ও সহায়তার অভাব, সময়ের চাপ, ঊর্ধ্বতনের
সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক, পরিবার ও কর্মস্থলের মধ্যে অসামঞ্জস্য, বদলি, পদোন্নতিতে দেরি, রাজনৈতিক, সরকারি
সংস্থা ইত্যাদির পক্ষ থেকে বাহ্যিক চাপ,
অন্যের সঙ্গে তুলনায় বৈষম্য ও হীনম্মন্যতার বোধ
অন্যতম।
প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বাত্মক হওয়ার
সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যাংকারদের দায়িত্ব। একসময় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব ছিল
আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেয়া। তারপর বাণিজ্যিক কারণে দিন দিন বেড়েছে সেবার পরিধি, তার
সঙ্গে বেড়েছে দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি। ব্যাংকিং নিয়মাচারকে কঠোর
শৃঙ্খলায় বেঁধে মূলধন ভিত্তি শক্ত করার জন্য ব্যাসেল ১ ও ২-এর ধারাবাহিকতায় ব্যাসেল
৩ প্রণীত হলে ব্যাংকারদের দায়িত্ব ও সতর্কতা আরো বেড়ে যাবে। এর মধ্যে ২০০৩ সালে
চালু হওয়া মানি লন্ডারিং আইন ও কেওয়াইসি
(নো ইউর কাস্টমার) বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের ফলে এ দায়িত্ব কেবল ব্যাংকের ওপর থাকে না, সংশ্লিষ্ট
ব্যাংক কর্মকর্তার ওপরও বর্তায়। ব্যাংকারদের বহুমুখী কর্মপরিধি, ব্যবসায়িক
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা এবং কঠোর নিয়মাচার পরিপালনের চাপ কেবল তাদের সাময়িক
ক্ষতিই করে না, দীর্ঘমেয়াদে জন্ম দেয় বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত, মানসিক
ও সামাজিক জটিলতার।
ব্যাংকিং খাতে কর্মীদের ওপর চাপ কমাতে
সঠিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংক কর্মীদের ওপর অযৌক্তিক
লক্ষ্যমাত্রা দেয়া যাবে না। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।
একই সঙ্গে পদোন্নতি ও প্রণোদনার বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকলে মানবিক ব্যাংকিং
খাত গড়ে তোলা সম্ভব। ব্যাংকিং খাতে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং টিকে থাকার লড়াই থেকে
ব্যাংক কর্মীদের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কারো ওপর
অযৌক্তিক চাপ দেয়া যৌক্তিক নয়। এতে হিতে বিপরীত হয়। ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে
অনেক ব্যাংক কর্মীদের আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে। লক্ষ্য পূরণ করতে
না পারলে পদোন্নতি থেকে শুরু করে বেতন বৃদ্ধিও আটকে যাচ্ছে। চাপের কারণে অনেক সময়
কর্মীরা ভুল করে বসেন হিসাবে। এতে বিপাকে পড়তে হয় গোটা ব্যাংককে। কর্মীদের চাপ
কমিয়ে আনতে করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশে এখনো বিস্তর গবেষণা হয়নি। অন্যান্য দেশে
ব্যাংকারদের চাপ কমিয়ে আনতে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয় ঝুঁকি গ্রহণ ও কাজের
জন্য। আমাদের এখানেও তা দেয়া হয়,
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর হার কমে এসেছে। তাছাড়া
চাকরির অনিরাপত্তাও বাড়ছে। এটি দেশের সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রবণতা, যার
রাশ টেনে ধরতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি।
ব্যাংকারদের অনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত
রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু দায়িত্ব
পালন করে বটে, কিন্তু তাদের কাছে এ-সংক্রান্ত অভিযোগ যায় কম। চাকরি হারানোর ভয়ে অধিকাংশ কর্মী তাদের
ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন না। এটি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বৃদ্ধি
এবং ব্যাংকারদের চাপ কমিয়ে আনতে নিয়মিত সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন সংশোধনের মধ্যে রাখা
উচিত। একই সঙ্গে ঝুঁকি গ্রহণ ও পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও
পদোন্নতির ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে চাপ প্রয়োগ করাও বাংলাদেশ ব্যাংকের
কাজ হওয়া উচিত। সামনে ব্যাংক খাতের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। ব্যাংকের
সঙ্গে সম্পৃক্ত সব অংশীজনের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। সবচেয়ে বেশি
প্রয়োজন ব্যাংকারদের আরো দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান পেশাগত কাজে
সর্বোত্তম উপায়ে প্রয়োগ করা। এক্ষেত্রে কর্মীদের চাপমুক্ত রেখে কীভাবে কাজ করানো
যায়, তার
উপায় খতিয়ে দেখতে হবে।