ছয় মাস ধরে
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির দখলকে কেন্দ্র করে চলছে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ,
যেটাকে বিশ্লেষকদের অনেকেই লিবিয়ার তৃতীয় গৃহযুদ্ধ
নামে অভিহিত করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী,
জুলাই পর্যন্ত এ যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে;
যাদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যাই শতাধিক। দুঃখজনকভাবে
এদের মধ্যে রয়েছেন অন্তত নয়জন বাংলাদেশীও!
লিবিয়ার পরিস্থিতি ২০১১ সালের গাদ্দাফিবিরোধী বিদ্রোহের
সময় থেকেই খারাপ। কিন্তু তার পরও প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য ২০১২ ও ২০১৩ বছর দুটি বেশ
ভালোই ছিল। শ্রমিক সংকটের কারণে এ সময় বাংলাদেশী শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা ছিল। তাদের
আয় অতীতের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নতুন করে লিবিয়ার পূর্ব ও
পশ্চিমের দুই সরকারের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হতে
শুরু করে, তখন তার
প্রভাব পড়তে শুরু করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ওপরও।
২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লিবিয়ার অবস্থা খুবই
খারাপ ছিল। এ সময় লিবিয়ার একাধিক শহরে ভিন্ন ভিন্ন বাহিনী পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
লিপ্ত ছিল। তেল উৎপাদন প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসায় এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে
তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় এ সময় লিবিয়ান দিনারের মানেরও চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। ২০১৪ সালের
শুরুতেও যেখানে ১ ডলারে প্রায় ১ দশমিক ৪ দিনার পাওয়া যেত,
সেখানে ২০১৬ সালে ১ ডলারের মান ৮ থেকে ৯ দিনারে গিয়ে
ঠেকে। এ সময়ই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী সমুদ্রপথে অবৈধভাবে ইতালিতে পাড়ি জমানোর চেষ্টা
করেন। অনেকে সফল হন, অনেকে
করুণ মৃত্যুবরণ করেন।
২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে লিবিয়ার পরিস্থিতি আবার
ভালো হতে শুরু করে। চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে পরাজিত করে লিবিয়ার পূর্ব ও পশ্চিমের দুই
সরকার দেশটির দুই অংশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়
গঠিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড
(জিএনএ) সরকার ধীরে ধীরে ত্রিপোলির আশপাশের শহরগুলোয়ও নিজেদের
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, তেল উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে,
ফলে দিনারের মানও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে
১ ডলার সমান প্রায় ৪ দশমিক ৩ দিনারে এসে দাঁড়ায়।
এ বছরের শুরুটা লিবিয়ার জন্য বেশ আশাব্যঞ্জক ছিল।
তেল উৎপাদন ও দিনারের মানের আরো বৃদ্ধির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
দুই সরকারের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতার ব্যাপারেও আলোচনা চলছিল। অনানুষ্ঠানিকভাবে শোনা
যাচ্ছিল, পূর্বাঞ্চলীয়
সরকারের সেনাবাহিনী প্রধান মার্শাল খালিফা হাফতার হয়তো নতুন প্রস্তাবিত ঐকমত্যের সরকারে
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং লিবিয়া পুনরায় একীভূত হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই আলোচনা ভেস্তে যায় এবং ৪ এপ্রিল খালিফা হাফতার
জিএনএ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুরো লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার লক্ষ্যে ত্রিপোলি অভিমুখে
অভিযান শুরু করেন।
লিবিয়ার এ মুহূর্তের যুদ্ধটি মূলত একটি আন্তর্জাতিক
প্রক্সিযুদ্ধ। একদিকে খালিফা হাফতারের পক্ষে আছে প্রধানত আরব আমিরাত,
সেই সঙ্গে তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে
ফ্রান্স, মিসর,
সৌদি আরব, সুদান ও রাশিয়ান মার্সেনারি বাহিনী। অন্যদিকে ত্রিপোলির
হাফতারবিরোধী সরকার ও তার মিত্রদের সাহায্য করছে প্রধানত তুরস্ক এবং সেই সঙ্গে আংশিকভাবে
কাতার। আর এ যুদ্ধে প্রাণ দিচ্ছে দুই পক্ষের লিবিয়ান সৈন্যরা,
যুদ্ধের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এ রকম লিবিয়ানরা,
সেই সঙ্গে সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশীসহ কিছু প্রবাসীও।
গত ছয় মাসের যুদ্ধে যে নয়জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন,
তাদের মধ্যে ছয়জনই নিহত হয়েছেন ৩ জুলাই ত্রিপোলির
একটি অভিবাসী আটক কেন্দ্রে চালানো বিমান হামলায়। এদের অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায়
এসেছিলেন মাত্র কয়েক মাস আগে, ইতালিতে যাওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু ধরা পড়ার পর তাদের
স্থান হয়েছিল এ আটক কেন্দ্রটিতে। আটক কেন্দ্রটির ঠিক পাশেই ছিল স্থানীয় মিলিশিয়াদের
একটি অস্ত্রাগার। পরপর দুটি বিমান হামলা হয়। একটি অস্ত্রাগারে এবং অন্যটি অভিবাসীদের
হ্যাঙ্গারে। নিহত হন অন্তত ৫৩ জন, আহত হন আরো ১৩০ জন। বাংলাদেশী চারজনের মরদেহ চিহ্নিত
করা সম্ভব হয়। বাকি দুজন নিখোঁজ রয়ে যান। ধারণা করা হয়,
তারাও নিহত হয়েছেন,
কিন্তু তাদের মরদেহ এমনভাবে বিকৃত হয়ে গেছে যে তা
চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনা আমাদের সামনে পুরনো একটি সমস্যাকে নতুন করে
তুলে ধরে। ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশীদের অবৈধভাবে লিবিয়ায় আগমন সমস্যা। বাংলাদেশ
সরকার দীর্ঘদিন ধরেই লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। কিন্তু
অবৈধভাবে লিবিয়ায় প্রবেশের ওপর তা বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। বেনগাজির বেনিনা
ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে কর্মরত এক বাংলাদেশীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী,
এ যুদ্ধের মধ্যেও প্রতিদিনই ২৫-৩০ জন বাংলাদেশী অবৈধভাবে
ওই এয়ারপোর্ট দিয়ে লিবিয়ায় প্রবেশ করছেন। এদের অধিকাংশই লিবিয়ায় আসছেন কেবল ইতালিতে
যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
এদের প্রায় সবাই লিবিয়ায় আসছেন দুবাই হয়ে। বাংলাদেশ
থেকে যেহেতু লিবিয়াগামী যাত্রীদের ছাড়পত্র দেয়া হয় না,
তাই দালালরা এদের সরাসরি লিবিয়ায় না এনে প্রথমে ট্যুরিস্ট
ভিসায় দুবাই নিয়ে যায়। এরপর সেখান থেকে নতুন করে এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টে লিবিয়ায় পাঠানোর
ব্যবস্থা করে। যারা শুধু লিবিয়ায় আসতে চান, তাদের খরচ হয় সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। আর যারা
ইতালি পর্যন্ত যেতে চান, তাদের খরচ হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা।
অবৈধভাবে দুবাই হয়ে খুব সহজে লিবিয়ায় আসা গেলেও ঝামেলায়
পড়েন বৈধ প্রবাসীরা। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বৈধভাবে লিবিয়ায় বসবাস
করা বাংলাদেশীরাও তিন-চার বছর
ধরে দেশে যেতে পারছেন না এ আশঙ্কায় যে তারা হয়তো আর ফিরে আসতে পারবেন না। এমন অনেক
ঘটনা ঘটেছে, যেখানে
সব কাগজপত্র, পাসপোর্ট,
ভিসা, কোম্পানির সার্টিফিকেট এমনকি বাংলাদেশ দূতাবাসের
সুপারিশপত্র থাকা সত্ত্বেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে প্রবাসীরা
ছুটিতে গিয়ে লিবিয়ায় ফিরে আসতে পারেননি।
ছুটিতে দেশে যাওয়া বাংলাদেশীদের অধিকাংশেরই লিবিয়ায়
লেনদেন বাকি রয়ে যায়, কোম্পানিতে
বেতন বকেয়া রয়ে যায়। ফিরে আসতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রেই বকেয়া বেতন উদ্ধার করে সম্ভব
হয় না। ফলে বৈধ পথে ফিরতে না পেরে অনেকেই পরবর্তী সময়ে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ
করে অবৈধ পথে লিবিয়ায় প্রবেশ করেন। ফলে এরা নিজেরাও বিপদে পড়েন এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও
ক্ষুণ্ন করেন। অন্যদিকে অনেকে একেবারেই ফিরতে পারেন না। ফলে রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় তাদের
পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে।
সরকারের হয়তো আশঙ্কা,
এ লোকগুলো লিবিয়ায় ফিরে এসে অবৈধ পথে ইতালিতে যাওয়ার
চেষ্টা করবেন। কিন্তু এ আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। যারা লিবিয়ায় অন্তত পাঁচ-ছয় বছর ধরে স্থায়ী,
যারা মোটামুটি ভালো অর্থ উপার্জন করেন এবং যারা কয়েক
লাখ টাকা খরচ করে দেশে ছুটিতে গিয়ে আবার ফিরে আসার সামর্থ্য রাখেন,
তারা সাধারণত ইতালিতে যান না। তাদের ইতালিতে যাওয়ার
প্রয়োজনই হয় না।
তাছাড়া দীর্ঘদিন লিবিয়ায় থাকার কারণে তারা বাস্তবতা
সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। তারা জানেন, ২০১৫-১৬ সালে ইতালিতে যাওয়া বেশ সহজ থাকলেও বর্তমানে
ইতালির লোকরঞ্জনবাদী, অভিবাসনবিরোধী
সরকারের সঙ্গে লিবিয়ান মিলিশিয়াদের চুক্তির কারণে ইতালিতে যাওয়া খুবই কঠিন,
বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বর্তমানে লিবিয়া
থেকে ছাড়া ট্রলারগুলোর অধিকাংশই মাঝ সমুদ্রে ডুবতে বসলেও যাত্রীদের উদ্ধার করে ইতালিতে
নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ইতালিয়ানরা লিবিয়ান কোস্টগার্ডকে খবর দেন। ফলে যাত্রীদের স্থান
হয় লিবিয়ান মিলিশিয়াদের দ্বারা পরিচালিত কুখ্যাত ডিটেনশন সেন্টারগুলোয়।
এ মুহূর্তে লিবিয়ায় আনুমানিক ২৫ হাজার বাংলাদেশী
রয়েছেন। ২০১১ সালের আগে থেকেই বৈধ বাংলাদেশীদের পাশাপাশি এদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন,
যারা গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে অবৈধভাবে লিবিয়ায় প্রবেশ করলেও বর্তমানে
কোনো না কোনো কোম্পানিতে বৈধভাবেই কর্মরত। অল্পকিছু ব্যতিক্রম বাদে এদের অধিকাংশই মোটামুটি
ভালো অবস্থায় আছেন। যারা মোটামুটি নতুন, একেবারেই কোনো ধরনের কাজকর্ম জানেন না,
তারাও মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা রোজগার করতে পারছেন।
আর যারা একটু পুরনো, কোনো
পেশায় নিয়োজিত, তাদের
আয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ, এমনকি অনেকের এর চেয়েও বেশি। ফলে এরা কেউই জীবনের
ঝুঁকি নিয়ে ইতালিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন না।
অন্যদিকে যারা সম্পূর্ণ নতুন করে অবৈধভাবে দুবাই
হয়ে লিবিয়ায় প্রবেশ করছেন, তারা লিবিয়ায় এসেই বিভিন্ন ধরনের বিপদের সম্মুখীন
হচ্ছেন। কাগজপত্র না থাকায় এবং পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত না হওয়ায় তারা সহজেই মিলিশিয়াদের
হাতে অপহূত হচ্ছেন, দেশে
মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়ে ইতালিতে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবারো অভিবাসী আটক কেন্দ্রে
আটকা পড়ছেন। আটক কেন্দ্রগুলো মিলিশিয়াদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় সেখানে তাদের থাকতে
হচ্ছে প্রতিপক্ষের বিমান হামলার ঝুঁকির মধ্যে।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের আরেকটি বড় ঝামেলা পোহাতে হয়
দূতাবাসসংক্রান্ত কাজের ক্ষেত্রে। যেহেতু লিবিয়ার দুই অংশে দুই সরকার,
তাই বৈধ কাগজপত্র থাকলেও দেশটির এক অংশ থেকে অন্য
অংশে আসা-যাওয়ার
সময় হয়রানির শিকার হতে হয়। পাকিস্তান, ফিলিপাইন বা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও
যদি লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে কনস্যুলার সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা করত,
তাহলে প্রবাসীদের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হতো।
লিবিয়া প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য সরকারের এদিকে দৃষ্টি
দেয়া খুবই জরুরি। সরকারের উচিত বৈধভাবে লিবিয়ায় কর্মরত প্রবাসীদের জন্য দেশে ছুটিতে
গিয়ে পুনরায় ফিরে আসার প্রক্রিয়া সহজ করে দেয়া এবং একই সঙ্গে অবৈধভাবে দুবাই কিংবা
অন্য কোনো রুট হয়ে লিবিয়ায় প্রবেশ বন্ধ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাহলে একই
সঙ্গে রেমিট্যান্সের প্রবাহ অব্যাহত থাকবে, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে না এবং অবৈধভাবে ইতালিতে
যাওয়ার চেষ্টা করে প্রাণহানিও হ্রাস পাবে।
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা: সিভিল ইঞ্জিনিয়ার
ত্রিপোলি,
লিবিয়া