
নাজমা আরো অনেক প্রবাসী নারী শ্রমিকের
মতো সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তিনি দারিদ্র্য নিরসনের জন্য দালালের মাধ্যমে ‘কাজ’ নিয়ে সৌদি আরব
যান একটি হাসপাতালে ক্লিনারের কাজ করবেন বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা গিয়ে ঠেকে
গৃহশ্রমিকের (ডমেস্টিক ওয়ার্কার)
কাজে। অতঃপর নির্যাতনের শিকার নাজমা লাশ হয়ে গত
২৪ অক্টোবর মধ্যরাতে নিজ দেশে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
পৌঁছেন। নাজমার পাসপোর্টে তখনো মেয়াদ রয়েছে ২৯ মে ২০২৩ পর্যন্ত। পাসপোর্টের মেয়াদ
শেষ হতে আরো চার বছর বাকি, অথচ তিনি নিজেই পরলোকগত হয়ে গেলেন। নাজমা নির্যাতন সইতে না পেরে
অনেকভাবে দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু
তা হয়নি। নাজমা তার মৃত্যুর আগে কয়েকবার ভিডিও করে তার অবস্থা বর্ণনা করে তাকে
ফেরত নেয়ার জন্য আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু জীবিত নাজমাকে ফেরত আনা হয়নি। শুধু
নাজমা নয়, সুমি আক্তার নামে আরো একজন গৃহশ্রমিক ফেসবুক ভিডিওতে তার ওপর যৌন
নির্যাতনের অভিযোগ এনে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার আকুতি জানিয়েছেন। তাকে ফিরিয়ে আনা হবে
কিনা এখনো জানা যায়নি। নাজমা মরে গিয়েও নানা প্রক্রিয়া শেষে দেশে ফিরতে লেগেছে ৫৩ দিন।
নাজমার মরদেহ প্রথম নয়, এর আগেও আরো অনেক নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মরদেহ বাক্সবন্দি হয়ে ঢাকার
বিমানবন্দরে এসেছে। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে গত তিন বছরে ৩৩১ জন নারী কর্মীর মৃত্যু
হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বছরের জুন পর্যন্ত ৬০ নারী শ্রমিকের মরদেহ দেশে এসেছে। যে
স্বজনরা তাদের ছেলে বা মেয়ে,
স্বামী বা স্ত্রীকে নিতে এসে সঙ্গে নানা রকম
উপহারসামগ্রী আনবে বলে আনন্দে থাকতেন,
এখন তাদের দেখা যায় বুকফাটা কান্নায় ফেটে পড়তে।
বিমানবন্দরের আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে এ কান্নায়।
যারা বিদেশে গিয়ে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে
কিছু আয় করেন, মনে হয় যেন তারা শুধু নিজের পরিবারের জন্যই বিদেশ যান। আসলে তারা একই
সঙ্গে দুটো ভূমিকা পালন করেন। এক.
তারা নিজ সংসারের আর্থিক অবস্থা উন্নত করেন, দুই. তারা
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান,
যাকে আমরা রেমিট্যান্স বলি। অর্থাৎ তাদের
প্রবাসে কাজ করার মাধ্যমে দেশও উপকৃত হয়। রেমিট্যান্সের অর্থ পাওয়া যায়, যাতে
দেশ চলে। অথচ যখন এই নারী শ্রমিকরা বিদেশে বিপদগ্রস্ত হন এবং সহায়তা চান, তখন
তারা কেন কোনো সাহায্য পান না,
তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। নাজমা একা এমন
পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তা তো নয়। নাজমার মৃত্যু বেশি নাড়া দিয়েছে, কারণ
তিনি মৃত্যুর আগে ভিডিওতে আকুতি জানিয়েছিলেন দেশে ফেরার জন্য। কেউ তখন তাকে সহায়তা
করেনি।
যেসব নারী শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরে এসেছেন, তাদের
সব সৌদি আরব থেকে নয়; জর্ডান, লেবানন, আরব আমিরাত, ওমানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এসেছেন। তবে সৌদি আরব থেকে আসার সংখ্যাই
সবচেয়ে বেশি। তাদের মৃত্যুর নানা কারণ বলা হয়েছে কিন্তু আত্মহত্যার সংখ্যাও কম নয়।
তাছাড়া শুধু লাশ হয়েই নয়, কাজের জন্য গিয়ে পুরো সময় পার না করেই নানা ধরনের নির্যাতনের কারণে
দেশে ফিরে এসেছেন অনেক নারী। তবুও তারা জানেন যে বেঁচে গেছেন। নাজমার মৃত্যু সমাজে
এত বেশি নাড়া দিয়েছে যে এখন বিদেশে কোনো নারী শ্রমিক আর না পাঠানোর দাবি উঠছে। এ
বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রবাসী নারী শ্রমিকরা নিজেরা কী চান, তা
আমাদের জানারও চেষ্টা করতে হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে যেসব প্রশ্ন সামনে
আসছে তা হলো:
এক. গৃহশ্রমিক হিসেবে প্রবাসে নারীর কাজ
বাড়ছে কিন্তু এখানেই নির্যাতন সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশী শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক
নিয়োগকারী সংস্থা, বায়রার হিসাব অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে ৮ লাখ ৬০ হাজার নারী শ্রমিক বিভিন্ন
ধরনের কাজ করছেন। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে
গৃহশ্রমিক হিসেবে নারীদের নেয়া শুরু হলো। প্রথমে ২০ হাজার নিলেও ২০১৭ সালে এসে
মাত্র দুই বছরে তা চার গুণ বেড়ে দাঁড়াল ৮৩ হাজার। প্রশ্ন হচ্ছে, এত
সংখ্যক নারী, সবাই কি জানতেন যে তাদের গৃহশ্রমিক হিসেবে নেয়া হচ্ছে? নাজমার
কথায় মনে হচ্ছে সবাই জানেন,
এমন কথা হলফ করে বলা যাবে না। কিন্তু এটা জানা
না-জানা
কি শুধুই শ্রমিক এবং প্রেরণকারী দালালের ব্যাপার? সরকারের কি এখানে কোনো ভূমিকা নেই?
দুই. নারী শ্রমিকরা প্রবাসে কাজ করার জন্য
যেতে চেয়েছেন কিন্তু সেটা গৃহশ্রমিকের কাজ হবে এমন জেনে সবাই যাননি কিংবা গেলেও
যাওয়ার পর সেখানকার কাজের পরিবেশ মেনে নিতে পারেননি, তা বোঝা যায় তাদের ফিরে আসার সংখ্যা
দেখে। মাত্র তিন বছরে পাঁচ হাজার নারী শ্রমিক ফিরে এসেছেন ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার
হয়ে। এ সংখ্যা আরো বাড়ছে। ২০১৯ সালেই ফেরত এসেছেন ৮০০ জন; তার
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক মরদেহ। যারা ফিরে এসেছেন, তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল কাজের সময় ১৪
থেকে ২০ ঘণ্টা, বেতন ঠিকমতো না পাওয়া,
অত্যন্ত কম বেতনে তাদের নিয়োগ করা, কোনো
প্রকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকা ইত্যাদি। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অসহনীয়
হয়ে উঠেছিল তাদের জন্য। এর সঙ্গে যৌন নির্যাতনও যুক্ত হয়েছে অনেকের ক্ষেত্রে, যা
পুরো বিষয়টিকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। নিজ পরিবারের জন্য কিছু আয়-উন্নতি বাড়াতে
নারীকে এত মূল্য দিতে হবে?
তিন. আরো একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে তা হলো, সৌদি
আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর জন্য আলাদা চুক্তি কেন করা হলো? আমরা
জানি, তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার।
সৌদি আরবে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা
মোট রেমিট্যান্সের ১৮ শতাংশ। কাজেই সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানোর আগ্রহ সরকারের থাকবে, এতে
দোষের কিছু নেই। রেমিট্যান্স পেতে ভালো লাগে অথচ যাদের মাধ্যমে এ রেমিট্যান্স আসে
তাদের কোনো প্রকার সহায়তা দিতে ভালো লাগে না!
সেখানে দূতাবাস রয়েছে, যার
দায়িত্ব হচ্ছে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা করা,
অন্তত আর কিছু না হোক তাদের সেই দেশে জীবনের
নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করা,
তা না হলে তাদের নিরাপদে দেশে ফিরে আসতে সাহায্য
করা। কিন্তু সেটা হয়নি।
জনশক্তি রফতানি বলতে সরকার মূলত পুরুষ
শ্রমিকই বোঝে। নারী শ্রমিকদের সৌদি আরবে পাঠানো তাদের মূল লক্ষ্য ছিল না। মূল
লক্ষ্য ছিল পুরুষ শ্রমিকদের পাঠানোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা সৌদি সরকার জারি করেছিল, তা
তুলে নিয়ে অধিকসংখ্যক পুরুষ শ্রমিক পাঠানো। এ নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্য তত্কালীন দুই
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মনি ও আবুল হাসান মাহমুদ আলী অনেক দেনদরবার করেছিলেন। প্রায় ছয়
বছরের নিষেধাজ্ঞা থাকার পর ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সৌদি আরবের শ্রমবাজার
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। এ বছরেই ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে
বাংলাদেশ সরকার গৃহশ্রমিক পাঠানোর জন্য একটি চুক্তি করে। তবে এ চুক্তিটি ছিল
বিদ্ঘুটে। এ চুক্তিতে একটি ধারায় বলা হয়েছে তিনজন পুরুষ শ্রমিক নিতে হলে একজন নারী
গৃহশ্রমিক দিতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার নারী শ্রমিকদের অনেকটা ‘তিনটি
কিনলে একটি ফ্রি’ নীতিতে পাঠানোর চুক্তি করেছিল এবং বলা হয়েছে প্রতি মাসে ১০ হাজার
গৃহশ্রমিক যাবে, তাদের কোনো খরচ দিতে হবে না। অথচ সৌদি আরবে যে এ ধরনের গৃহশ্রমিক
নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তা ২০১০ সালেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে জানা গেছে।
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার নারী শ্রমিকদের ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, প্রতিবেদনে
তা তুলে ধরা হয়। যে কারণে সৌদি আরবে কেউ গৃহশ্রমিক হয়ে যেতে চান না। অথচ গৃহশ্রমিক
বাদে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার আরো প্রায় ৪৮ ক্যাটাগরির খাত আছে। এটা ঠিক গরিব ও কম
লেখাপড়া জানা নারীদের জন্য কাজের ক্ষেত্র গৃহশ্রমিক ছাড়া সীমিত। তাই তারাও বাধ্য
হন এ কাজ করতে। সৌদি নাগরিকরা গৃহশ্রমিক হিসেবে সহজে এবং সস্তায় নিতে পারেন বলে
তাদের আগ্রহ আছে বাংলাদেশী নারীদের প্রতি। মাত্র ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ রিয়াল খরচ
করে একজন বাংলাদেশী গৃহকর্মীকে কাজে নিতে পারেন তারা।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে নারীরাও
প্রবাসী শ্রমিক হয়ে বিদেশে গিয়ে আয়-উপার্জন করতে চান। তারা খুবই পরিশ্রম করেন, খাওয়াদাওয়ার
ঠিক থাকে না, তবুও নিজের সংসার ও সন্তানের জন্য কিছু করার উপায় হিসেবে তারা যেতে
চান। সৌদি আরবে গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের কারণে যদি নারীদের বিদেশ যাওয়াকে নিরুৎসাহিত
করা হয়, তা তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। নারীদের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ
সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বছর বছর তাদের সংখ্যা বাড়ছে। যেমন ২০১৪ সালে বিভিন্ন দেশে
নারী শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা ছিল ৭৬ হাজার ৭,
২০১৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭১৮।
২০১৬ সালে এ সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮-তে। তবে সৌদি আরবে নারী
শ্রমিক নির্যাতনের কারণে সেখানে নারীদের যাওয়ার হার কমে যায়।
নির্যাতিত নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে
সবচেয়ে বেশি হলেও অন্যান্য দেশ থেকে আসছেন না এমন নয়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাব অনুযায়ী সৌদি আরব থেকে ২৬, জর্ডান
থেকে ৯, লেবানন থেকে ৯, আরব আমিরাত থেকে ৪,
ওমান থেকে ৩ ও বিভিন্ন দেশ থেকে আরো ৯ নারীর
মরদেহ দেশে ফিরেছে।
অর্থাৎ আমরা যতই বলি না কেন, আমাদের
সরকার নিজে যদি প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ না করে তাহলে সৌদি আরব
কেন কোনো দেশেই নারীদের জীবন ও সম্মান রক্ষা করা যাবে না। আমরা যদি নিজেরা জোর
দিয়ে না বলি যে আমার শ্রমিক তার দায়িত্ব পালন করবেন কিন্তু তার মানবিক মর্যাদা
ক্ষুণ্ন করার অধিকার কারো নেই। তিনি শ্রম দিতে এসেছেন কিন্তু তার পুরো শরীর তার
নিজের। এ শরীরে একটি আঁচড়ও কেউ লাগাতে পারবে না। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম
সংস্থার সঙ্গে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সমঝোতা চুক্তির কিছু নীতিমালা করেছে। এর
মধ্যে নারী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে
সৌদি আরবের চুক্তি অনেক আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রাখা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো নারী গৃহশ্রমিকদের জন্য বহুভাষিক হটলাইন এবং ২৪ ঘণ্টা সহায়তা
দেয়ার ব্যবস্থার কথা বলা আছে।
দেখার বিষয় হলে বাংলাদেশ থেকে নারী
গৃহশ্রমিক পাঠনোর সময় কি এসব বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয়ার কোনো ব্যবস্থা করা হয়? নারী
শ্রমিকদের মান-সম্মান বজায় রাখা এবং জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের
দায়িত্ব। এ দায়িত্বে ন্যূনতম অবহেলা কাম্য নয়।
ফরিদা আখতার: নির্বাহী
পরিচালক
উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)