[পূর্ব প্রকাশের পর]
এবার দেখি পূর্ণসংখ্যার সেটকে। সেটটি হলো
(..., -৪,
-৩,
-২,
-১,
০,
১,
২,
৩,
৪...)। এ সেটটিতে শূন্যের আগে-পরে দুদিকেই সংখ্যার শেষ নেই।
সেটটিকে চাইলে আমরা এভাবেও লিখতে পারি (০,
১,
-১,
২,
-২,
৩,
-৩,
৪,
-৪...)। ভাবছেন নিশ্চয়ই এ সেটটিতে
স্বাভাবিক সংখ্যার সেটের চেয়ে বেশি সংখ্যা আছে। ব্যাপারটা জোড় তৈরি করে দেখা যাক:
১g০;
২g১;
৩g-১;
৪g২;
৫g-২;
৬g৩;
৭g-৩
এবারো আমরা দেখছি যে জোড় বাঁধা সম্ভব হচ্ছে এবং সংখ্যা শেষ হয়ে
যাচ্ছে না। তার মানে পূর্ণ সংখ্যার সেটেও স্বাভাবিক সংখ্যার সেটের সমানসংখ্যক সংখ্যা
আছে, যা হলো আলেফ নাল।
এবার আসুন ভাবি অন্য ধরনের সংখ্যা নিয়ে। এমন এক ধরনের সংখ্যা
হলো র্যাশনাল বা মূলদ সংখ্যা। এ সংখ্যাগুলোকে দুটি পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশ হিসেবে দেখানো
যায়, যেমন ১, ২,
১/২,
১/৩,
-৩/৪ ইত্যাদি। কান্টর দেখালেন
যে সহজেই এ সংখ্যাগুলোকে স্বাভাবিক সংখ্যার সঙ্গে জোড় তৈরি করে দেখানো যায়। প্রক্রিয়াটা
নিচে দেখানো হলো শুধু ধনাত্মক সংখ্যা ব্যবহার করে:
১/১ ১/২ ১/৩ ১/৪ ১/৫ ১/৬...; ২/১ ২/২ ২/৩ ২/৪ ২/৫ ২/৬...;
৩/১ ৩/২ ৩/৩ ৩/৪ ৩/৫ ৩/৬...;
৪/১ ৪/২ ৪/৩ ৪/৪ ৪/৫ ৪/৬...
একটু ভেবে দেখুন যে আমরা সব ধনাত্মক মূলদ সংখ্যার তালিকা করতে
পেরেছি কিনা। দেখুন যে কয়েকটি সংখ্যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। পুনরাবৃত্তিগুলো বাদ দিয়ে
আমরা কোনাকুনি দিক থেকে ধরে একটা তালিকা করতে পারি:
১, ২,
১/২,
১/৩,
৩/১,
৪,
৩/২,
২/৩... এ তালিকায় সব মূলদ সংখ্যা
আছে। পাঠক এ পর্যন্ত না বুঝতে পারলে একটু বিরতি দিয়ে ভেবে দেখুন। আমরা যেহেতু তালিকা
করতে পেরেছি, তাই আগের প্রক্রিয়ায় সহজেই স্বাভাবিক সংখ্যার সঙ্গে জোড় তৈরি
করে দেখাতে পারব। তার মানে মূলদ সংখ্যাও আছে আলেফ নাল পরিমাণে। মূলদ সংখ্যা ও স্বাভাবিক
সংখ্যার তাই সমান অসীমত্ব।
এবার আসুন রিয়েল নাম্বার বা বাস্তব সংখ্যায়। মূলদ ও অমূলদ
(ইর্যাশনাল)
সংখ্যা মিলে হয় বাস্তব সংখ্যা।
একটি নাম্বার লাইনের উপরে যে সংখ্যাগুলো থাকে, তারা সবাই বাস্তব সংখ্যা। ভাবছেন
যে এবারো অসীমত্ব হবে আলেফ নাল। কান্টর দেখালেন অমূলদ সংখ্যার অসীমত্ব আলাদা। প্রমাণটা
দেখানোর জন্য আসুন মনে করি যে শূন্য থেকে ১ পর্যন্ত যতগুলো বাস্তব সংখ্যা আছে,
তার একটা তালিকা করা যাবে,
ঠিক যেভাবে মূলদ সংখ্যার তালিকা
করা হয়েছিল। মনে করি যে তালিকাটা বানানোর পরে স্বাভাবিক সংখ্যার সঙ্গে নিচের মতো করে
জোড় করা হয়েছে: ১g.১২৫৪৬;
২g.১৩৪৫৬২৩৪ ;
৩g.১৪৫৬৭৩;
৪g.২৫৬৭৮৯;
৫g.৪৫৬৩৪৫
ধরা যাক এ তালিকায় সব বাস্তব সংখ্যা আছে। যেহেতু তালিকা বানিয়ে
জোড় তৈরি করা হয়েছে, তাই এ তালিকা অনুযায়ী বাস্তব সংখ্যার অসীমত্বও হলো আলেফ নাল।
এবার তালিকার প্রথম সংখ্যা থেকে প্রথম,
দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে দ্বিতীয়,
তৃতীয় সংখ্যা থেকে তৃতীয়,
চতুর্থ থেকে চতুর্থ,
পঞ্চম থেকে পঞ্চম এভাবে একটা
সংখ্যা করি। যেহেতু এ তালিকায় অসীমসংখ্যক সংখ্যা আছে,
তাই আমাদের তৈরি করা সংখ্যাটাও
অসীম দৈর্ঘ্যের হবে। এবার সংখ্যাটার সঙ্গে ১ যোগ করি। এই নতুন সংখ্যাটা হলো আমাদের
উপরের তালিকা হিসাবে .২৪৬৮৫...।
এবার আসুন দেখি সংখ্যাটা তালিকায় আছে কিনা। সংখ্যাটি প্রথম সংখ্যাটি
নয়, কারণ প্রথম ঘরটি মিলছে না। দ্বিতীয় নয়,
কারণ দ্বিতীয় ঘরটি মিলছে না।
তেমনি করে মিলছে না অন্য সংখ্যাগুলোর ঘরগুলোর সঙ্গেও। অর্থাৎ সংখ্যাটি সম্পূর্ণ একটা নতুন সংখ্যা,
যা আগের তৈরি করা তালিকায় নেই।
তার মানে আমাদের আগের অনুমানটি ভুল যে আমরা বাস্তব সংখ্যার একটা
তালিকা করতে পারব। আমরা যতভাবেই তালিকা করি না কেন, আরো অসীমসংখ্যক বাস্তব সংখ্যা
তালিকার বাইরে থেকে যাবে। তাই স্বাভাবিক সংখ্যার সঙ্গে বাস্তব সংখ্যার একেক করে জোড়
কখনো সম্ভব হবে না। তাই নিশ্চয়ই বাস্তব সংখ্যার অসীমত্ব স্বাভাবিক সংখ্যার অসীমত্ব
থেকে আলাদা ও বৃহৎ। আসুন এই অসীমত্বের নাম দিই
আলেফ ১।
আমরা এখন পর্যন্ত দুই আকারের অসীমত্ব পেলাম। আরো অন্য আকারের
আছে কি? কান্টরের যুক্তি অনুসারে আছে। আমরা চাইলে দেখাতে পারব আলেফ ১-এর
পরে আছে আলেফ ২, তার পরে আছে আলেফ ৩, আলেফ ৪,
আলেফ ৫। এভাবে চলতেই থাকবে।
চলতে চলতে আমরা পৌঁছব আলেফ অসীমে। কান্টরের গণিতে আলেফ অসীমের পরে আর কোনো অসীমত্ব
নেই। এ অসীমত্বই পরম অসীমত্ব।
পাঠক এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কান্টর কী আশ্চর্য জগতের সন্ধান
জানিয়ে গেছেন। সমসাময়িকদের অনেকেই কান্টরের যুক্তি মেনে নিতে পারেননি। বিভিন্নভাবে
তাকে বিদ্রূপের স্বীকার হতে হয়েছে। কান্টরের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরো পরে। কিন্তু
মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আগেই মানসিক রোগের কারণে কান্টরের হাসপাতালে আসা-যাওয়া শুরু হয়।
অসীমত্বের আকার কী, তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে।
কিন্তু অসীমত্বের সন্ধান দিতে কান্টর জন্ম দিয়ে গেলেন সেট থিওরি নামে গণিতের একটি শাখার।
আজকাল গণিতের সবকিছুই শুরু হয় সেটের ধারণা থেকে। এটি ছাড়া গণিতশাস্ত্র অচল। উচ্চতর
গণিতে সংখ্যার প্রাথমিক পাঠও শুরু হয় কান্টরের তৈরি করা ধারণাগুলো ব্যবহার করে। তাই
হয়তো ডাভিড হিলবের্ট ‘কান্টরের স্বর্গ থেকে আমাদের
কেউ বিতাড়িত করতে পারবে না’—এমন একটি উক্তি করে গিয়েছিলেন।
এ হাসপাতালে এসে কান্টর দেখলেন অসুখটা শুধু তারই। বাকি সবাই
সুস্থ-প্রাণবন্ত। পাঠক বিবেচনা করে দেখুন অসীম সুস্থতা আসলে কার ছিল।
মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী:
যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ ইউনিভার্সিটির
অর্থনীতির শিক্ষক