সরকারি কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ-উচ্চশিক্ষা

পেশাগত জীবনে কাজেই আসছে না দক্ষতা উন্নয়ন

জেসমিন মলি

স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিডি) জ্যেষ্ঠ সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন হেলাল উদ্দিন আহমেদ। কর্মদক্ষতা বাড়াতে নেদারল্যান্ডস স্পেন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে চলতি বছরের ২২ মে দেশে ফেরেন। তার পরদিনই অর্থাৎ ২৩ মে অবসরকালীন ছুটিতে চলে যান। ফলে কর্মকর্তার পেছনে করা সরকারের সেই খরচ কোনো কাজেই আসেনি। হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতো বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অবসরে যাওয়ার উদাহরণ যেমন রয়েছে, একইভাবে দপ্তর পরিবর্তনের ঘটনাও কম নয়। এতে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিদেশে গিয়ে অর্জিত দক্ষতা তেমন কাজে আসছে না তাদের পেশাগত জীবনে। তাই যাচাই-বাছাই ছাড়া যাতে কাউকে বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া না হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নেয়া বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা গিয়েছে, বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ শীর্ষক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার ৪০ ক্যাডার বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রথম পর্যায় শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে চলা প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫৩ কোটি টাকা।

প্রকল্পটির বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের কোন খাতে কতজন বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত জনবল দরকার তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিষয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনাও নেই। প্রশিক্ষণ শেষে কোথায় পদায়ন করা হবে, সে বিষয়েও নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। ফলে ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিদেশে নেয়া উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম অনেকেরই পেশাগত জীবনে কাজে লাগছে না।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, যিনি বাণিজ্য সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের দায়িত্বও পালন করেছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে যাকে যে বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষা দেয়া হয়, দেখা যায় তাকে সে বিষয়ে কাজ করারই সুযোগ দেয়া হয় না। এটা আমাদের প্লেসমেন্ট অব অফিশিয়ালসের মস্ত বড় দুর্বলতা। দুর্বলতা কাটানো দরকার।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অবশ্য বলছে, মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ নীতিমালার আলোকে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ নীতিমালাটিও যুগোপযোগী করার কার্যক্রম চলমান। তাছাড়া একটি সমন্বিত জাতীয় প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নীতিমালার খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে এরই মধ্যে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের পেশাদারিত্ব আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কয়েক ধাপে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় দেশে কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ যেমন নেয়া হয়েছে, একইভাবে বিদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ উচ্চশিক্ষার সুযোগও তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানেও তৈরি করা হয়েছে প্রশিক্ষণের সুযোগ। এছাড়া কর্মদক্ষতা বাড়াতে বিদেশে নিয়ে কর্মকর্তাদের দেয়া হয় বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ। এসব উচ্চশিক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মচারীদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি এবং জনসেবায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকে বিভিন্ন পাঠ্যসূচি। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া অস্ট্রেলিয়ায় বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া বিদেশে মাস্টার্স কোর্সেও অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে পর্যন্ত ৬০৩ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ৩৭৮ কর্মকর্তা বিদেশে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করেছেন, ১৯১ কর্মকর্তা অর্জন করেছেন পিএইচডি। এছাড়া আরো ১৪ কর্মকর্তা অন্যান্য কোর্সে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। আর বিসিএস কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রকল্পের আওতায় ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক মাস্টার্স ফেলোশিপে ৫১৭ জন, বৈদেশিক ডিপ্লোমা ডিগ্রিতে ১৪৯ জন, বৈদেশিক সংরক্ষিত প্রশিক্ষণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের হাজার ১৫৬ কর্মকর্তা উচ্চশিক্ষা বা উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাস্টার্স ফেলোশিপে ২৭৩ জন, পিএইচডি ফেলোশিপে ১৩ জন, বিদেশী ডিপ্লোমা ডিগ্রিতে ১৯ জন, বিদেশী সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণে বিভিন্ন পর্যায়ের ৮৮৪ জন অংশ নেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক . ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানো। এটা ইতিবাচক একটা বিষয় এবং এর প্রয়োজনও আছে। কিন্তু আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতির মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তা হলো সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়াকে ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ থেকে অর্জিত জ্ঞান দেশের উন্নয়নে তারা কাজে লাগাতে পারছেন না। অনেকেই এক দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসার পর অন্য দপ্তরে বদলি হয়ে যান। আবার প্রশিক্ষণ শেষ করে অনেক কর্মকর্তা চলে যান অবসরে। সংস্কৃতির জন্য প্রশিক্ষণে যাওয়া কর্মকর্তারা যেমন অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন, তেমনি তাদের যারা প্রশিক্ষণে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন তারাও অনৈতিক কাজ করছেন। সংস্কৃতি দূর করতে হলে প্রশিক্ষণে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেমন জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে, তেমনি যারা তাদের প্রশিক্ষণে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন, তাদেরও জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্রের মূল্যবান সম্পদের অপচয় চলতেই থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন