অর্থনৈতিক সংকটে জনপ্রিয়তা বাড়ছে ইমরান খানের

বণিক বার্তা ডেস্ক

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় অদক্ষতার অভিযোগে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন তার রাজনৈতিক বিরোধীরা। পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান খান সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা হাতে নেয় শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) এরপর সময় পেরিয়েছে তিন মাস। তিন মানে পাকিস্তানের অর্থনীতির সামান্যতম উন্নতি হয়নি। বরং সংকট দিনে দিনে তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে। দেশটিও এগিয়ে চলেছে দ্রুত দেউলিয়াত্বের পথে। স্থানীয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক সংকট যত তীব্র আকার নিচ্ছে, পাকিস্তানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তাও তত বাড়ছে।

সর্বশেষ পাঞ্জাব প্রদেশে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনের ফলাফলে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির নজির দেখা যায়। প্রদেশটি শরিফ পরিবারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। প্রদেশের স্থানীয় উপনির্বাচনে ২০টি আসনের মধ্যে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক--ইনসাফ পেয়েছে ১৫টি। আসনগুলোয় মোট ভোটের দুই-তৃতীয়াংশই পেয়েছে পিটিআই। এর আগে কখনই শরিফ পরিবারের বাইরে আর কেউ পাঞ্জাবের নির্বাচনে এমন ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। ২০টি আসনের মধ্যে শরিফ পরিবারের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নেওয়াজ) বা পিএমএল-এন পেয়েছে চারটি। চারটি আসন আবার শরিফ পরিবারের নিজেদের বা এর আশপাশের এলাকা। এছাড়া দেশটিতে পর্যন্ত উপনির্বাচনগুলোয় ভোটার উপস্থিতি সাধারণত খুবই কম দেখা যায়। কিন্তু এবারের উপনির্বাচনে ভোট দিয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি ভোটার।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পিএমএল-এন আসিফ আলি জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) অভূতপূর্ব এক যৌথ প্রয়াসে ইমরান খান সরকারের পতন ঘটালেও তাদের জোট পিডিএম বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে এখন সংশয় দেখা গিয়েছে। সংশয়কে আরো বাড়িয়ে তুলেছে পাঞ্জাবের উপনির্বাচনের ফল। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটির জনগণ এখন ক্ষমতাসীনদের ওপর বিরক্ত। দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দিনে দিনে তীব্রতা পাচ্ছে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ময়দানে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছেন ইমরান খান।

পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির অবস্থান মুদ্রাবাজারে ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠছে। গত দুই সপ্তাহে মুদ্রাটির অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় দশমিক শতাংশ। ২২৮ রুপি ছাড়িয়েছে প্রতি ডলারের বিনিময় হার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের হাতে রিজার্ভের পরিমাণ নেমে এসেছে প্রায় ৯৩৯ কোটি ডলারে, যা দিয়ে দুই মাসেরও আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব না। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশটির পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির বিভিন্ন স্থানে জায়গাভেদে দিনে থেকে ১৮ ঘণ্টা ব্ল্যাকআউটের ঘটনাও ঘটছে। জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত বিক্ষোভ-ধর্মঘটে নামছেন পরিবহন খাতের শ্রমিকরা। গত এক বছরে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেইলআউট হিসেবে যে অর্থ পাওয়ার কথা, সেটিও এখন পর্যন্ত আনতে পারেনি শাহবাজ শরিফের সরকার।

পার্লামেন্টে বিরোধী দলগুলোর যৌথ প্রয়াসে পিটিআইয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকে দেশটির জনগণের ব্যাপক সহানুভূতি পেয়ে আসছেন ইমরান খান। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই পশ্চিমারা একজোট হয়ে তার সরকারের পতন ঘটিয়েছে বলে দাবি করছেন তিনি। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তার দাবিকে সঠিক বলে মনে করছেন পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকরাও। এপ্রিলে পতনের পর থেকেই তার সমর্থকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক সংকটসহ সার্বিক পরিস্থিতি মুহূর্তে তাকে পরিচিত করে তুলেছে পাকিস্তানের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে। ভোটারদের যারা তাকে অতীতে খুব একটা পছন্দ করতে পারেননি, ইমরান খানের পক্ষে এখন রাস্তায় নামছেন তারাও।

পেশায় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার শাহিদ আসতোরি (২৭) ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খানের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ইমরান খানের অধীনে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করলে সাবেক ক্রিকেট বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের প্রতি তার বিরক্তির মাত্রা আরো বেড়ে গিয়েছিল। যদিও এপ্রিলের অনাস্থা ভোটে পতনের পর ইমরান খানের প্রতি তার বিরক্তি বদলে যায় সহানুভূতিতে। পিডিএম সরকার অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় তার ইমরান খানের প্রতি সহানুভূতি রূপ নিয়েছে সমর্থনে। করাচির রাজপথে ইমরান খানের সমর্থনে বের হওয়া মিছিল-বিক্ষোভে প্রায়ই যুক্ত হচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এফটিকে দেয়া এক বক্তব্যে ইমরান খানের প্রতি জোর সমর্থন আগাম নির্বাচন আয়োজনের দাবি ব্যক্ত করেন তিনি।

বর্তমানে ইমরান খান তার সমর্থকরা দ্রুত পার্লামেন্ট নির্বাচনের দাবিতে সক্রিয়তা বাড়াচ্ছেন। বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য হলো, দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার অবসরের সময় ঘনিয়ে আসছে। দ্বিতীয় মেয়াদে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালনে এরই মধ্যে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। পিডিএম সরকারের কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যাশা, নতুন অনুগত সেনাপ্রধান নিয়োগের মাধ্যমে পিটিআইয়ের ক্ষমতাগ্রহণ ঠেকাতে পারবে তারা। আবার নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগের সম্ভাবনাকে নিজেদের জন্য সুযোগ হিসেবে দেখছে পিটিআইও। এজন্যই ইমরান খান তার সমর্থকরা এখন দ্রুত আগাম নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে আরো সরব হয়ে উঠছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অবস্থায় দ্রুতই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট আরো ভয়াবহ রূপ নেয়ার বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য হলো ঋণ পেতে হলে, পাকিস্তানের স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। বরং অদূরভবিষ্যতে তা আরো গোলযোগপূর্ণ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আইএমএফ ঋণের কিস্তি পরিশোধ আটকে দিলে দেশটির জন্য তা আরো খারাপ পরিস্থিতির জন্ম দেয়ার বড় ধরনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন