চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ (১৯৫৬-২০১১)
ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত
‘মুক্তির গান’ আমার অসম্ভব পছন্দের একটি
প্রামাণ্যচিত্র। এটি মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভ্রাম্যমাণ একটি গানের
দলের ওপর নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র। প্রামাণ্যচিত্রের একটি অংশে
শিল্পীরা নৌপথ ভ্রমণ শেষে একটা জায়গায় নামেন। তাদের মধ্যে একজন মাটিতে নেমেই একদলা
মাটি হাতে নিয়ে গোল করে রেখে নিজের কাছে রেখে দেন। আহা মাটির প্রতি ভালোবাসার কী
নিদারুণ দৃশ্য। এ দৃশ্যের ওপরই
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি চলতে
থাকে। গানের একটা অংশে মুক্তিযোদ্ধারা গলা মিলিয়ে গানটি গাইছেন। সেই অংশটি দেখলেই আমার
শরীরে কেমন শিহরণ অনুভব করি।
রণাঙ্গনের সেই যোদ্ধাদের আবেগ, স্পৃহা, অনুভূতি
আমাকে অনুরণিত করেছে বারবার। আমি যতবারই দেখি, ততবারই একই রকম অনুরণিত বোধ করি।
যোদ্ধারা গাইছেন,
‘মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায়
রে...
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও
মা, আমি
নয়ন জলে ভাসি
আমার সোনার বাংলা, আমি
তোমায় ভালোবাসি।’
এ অসাধারণ গানটি লিখেছেন কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ গানের প্রথম ১০ লাইন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। এটি
আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হয়েছে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি। কিন্তু তার
আগে থেকে এটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হতো। আমি যতবারই জাতীয় সংগীতটি পড়ি, ততবারই
মুগ্ধতায় ডুবে যাই। কি সম্মোহনী শক্তি এ সংগীতের। এ সংগীতের জন্য আমরা কবিগুরুর
কাছে ঋণী।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রণাঙ্গনের
মুক্তিযোদ্ধা, দেশের আপামর জনসাধারণকে দেশের প্রতি আবেগতাড়িত করেছে এ সংগীত। গানের
কথাগুলোর মতো এমন একটা দেশ আমাদের প্রয়োজন,
এ তাগিদটা স্পষ্ট এই সংগীতে। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম। কবিগুরু এ গানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে
পরম বন্ধু হয়ে থেকেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রণাঙ্গনের
যোদ্ধারা অবদান রেখেছেন সম্মুখযুদ্ধ করে। কারণ আমাদের একটি স্বাধীন দেশ প্রয়োজন।
কিন্তু যে মানুষগুলো আমাদের দেশের নন,
তারাও যে এ দেশের স্বাধীনতার জন্য অবদান রেখেছেন, তারা
কিসের তাগিদ অনুভব করেছেন? তারা এ দেশের প্রতি শোষণ,
বঞ্চনা বন্ধের তাগিদে, কখনো
নিপীড়িত মানুষের সাহায্যার্থে,
কখনো বাংলাদেশকে ভালোবেসে বা বঙ্গবন্ধুকে
ভালোবেসে এ দেশের জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধ করেছেন। তাদের অবদান ভোলার মতো
নয়। তারা আমাদের পরম বন্ধু,
তারা আমাদের মিত্র। তাদের শক্তি আমাদের
রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের আরো বলশালী করে তুলেছে।
এ রকম একজন মিত্র বা পরম বন্ধু হলেন ডব্লিউএএস
ওডারল্যান্ড। তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। ১৯৭১ সালে ওডারল্যান্ড বাটা সু কোম্পানির
ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছিলেন। তার কার্যালয় ছিল টঙ্গীতে। দেশের
উত্তাল পরিস্থিতি দেখে তিনি আঁচ করতে পেরেছেন সবকিছু। তাই তিনি নিজ উদ্যোগে
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে যুদ্ধের সময় অবাধে চলাচলের সুযোগ কাজে
লাগান। তিনি বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাকিস্তানিদের গণহত্যা আর নির্যাতনের ছবি তুলে তা
গোপনে বিদেশী গণমাধ্যমে পাঠাতেন। একপর্যায়ে তিনি গভর্নর লে. জে. টিক্কা
খান ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে.
জে.
নিয়াজি,
রাও ফরমান আলীসহ পাকিস্তানি সেনাদের অনেক গোপন
পরিকল্পনার তথ্য নিয়মিত পাঠাতে থাকেন ২ নম্বর সেক্টরের মেজর এটিএম হায়দার ও জেড
ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে। ওডারল্যান্ড নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন
কর্নেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গেও। তিনি অনুভব করলেন, তার আরো বেশি কিছু করা জরুরি। তাই
তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কমান্ডো ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেন। টঙ্গীর বাটা
কারখানার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, তাদের নগদ অর্থ, খাদ্য
ও কাপড়চোপড় দিয়ে নানাভাবে সহায়তা করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেয়ার
পাশাপাশি তিনি নিজেও বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা যুদ্ধ চালান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ অকুতোভয়
মুক্তিযোদ্ধাকে ‘বীর প্রতীক’ সম্মান প্রদান করা হয়। তিনিই একমাত্র বিদেশী, যাকে
বাংলাদেশ সরকার এ খেতাবে ভূষিত করেছে। এ নির্ভীক যোদ্ধা ও পরম বন্ধুর ঋণ এ দেশ
কখনো শোধ করতে পারবে না। তাকে জানাই শ্রদ্ধা।
দুই.
একাত্তরের আরেক বন্ধু এয়ার মার্শাল
আসগর খান। তাহরিক-ই-ইশতেকলাল পার্টির প্রধান আসগর খান ৪ মার্চ ১৯৭১ করাচি প্রেস ক্লাবে বৃহৎ
এক সংবাদ সম্মেলনে একটি বক্তব্য দেন। ৫ মার্চ ১৯৭১ করাচির ইংরেজি দৈনিক ডন তা
বিস্তারিত প্রকাশ করে। মূলত তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যভিচারী কর্মকাণ্ডের
কথা সবাই জেনে যায়। তাই আসগর খান বলেছিলেন,
‘জাতীয় অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার সার্থে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উচিত
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী শেখ মুজিবুর রহমানকে ডেকে অবিলম্বে
তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’
ভাবা যায়, নিজ
দেশের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তারই দেশের এয়ার মার্শাল আসগর খান ইয়াহিয়ার ভুল
শুধরে সঠিক পথে আসতে বলছেন। আসগর খান যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তখন
এ ধরনের সাহস দেখিয়ে কথা বলার মতো লোকই ছিল না।
আসগর খানের মতো আরেকজন লোক কথা বলে
সবাইকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিতেন। তিনি হলেন বেতারে মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠস্বর
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তখন খবর পড়তেন ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের আকাশবাণীতে। ‘আকাশবাণী কলকাতা,
খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’—ভরাট
কণ্ঠের এ সম্ভাষণ বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করত। তার আবেগভরা কণ্ঠস্বর
আশাজাগানিয়া হয়ে ওঠে যুদ্ধরত বাঙালিদের কাছে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে উজাড়
করে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন শব্দসংগ্রামী হয়ে উঠেছিলেন। কোটি মানুষের
আগ্রহের একটি বিন্দু হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘অদেখা
পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীদের প্রতি নৈকট্যবোধে আমার মন আপ্লুত হয়েছে বারবার। আর
কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।’
আরেকজন পরম বন্ধু হলেন ফাদার মারিনো
রিগন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সংগঠক ও সহায়তাকারী একজন বন্ধু। তিনি ছিলেন
ইতালির নাগরিক। ১৯৫৩ সালে ২৮ বছর বয়সে ধর্ম প্রচার করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফাদার
মারিনো রিগন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের
চিকিৎসাসেবা দিতেন। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে তিনি চারটি নৌকা বানিয়েছিলেন—‘সংগ্রামী
বাংলা’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’,
‘স্বাধীন বাংলা’ ও ‘মুক্ত বাংলা’।
মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো উঠে এসেছে তার ডায়েরিতেও। নিজের ডায়েরি ও চারটি নৌকা
২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়ে দেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের আরেকজন সখা
হলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। তিনি ছিলেন মার্কিন সিনেটর। পাকিস্তানি বাহিনীর
গণহত্যাযজ্ঞের খবর তখনো ছড়ায়নি। ঢাকা থেকে মার্কিন কনসাল আর্চার ব্লাডের গোপন
রিপোর্ট পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন এডওয়ার্ড কেনেডি। তিনি ১ এপ্রিল ১৯৭১ মার্কিন সিনেটে
বাংলাদেশসংক্রান্ত তার প্রথম বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘মাননীয়
সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ঘটনার বিপুল জটিলতা আমি অনুধাবন করি। কূটনীতিক ও
মানবতাবাদীদের জন্য এ এক জটিল বিষয়। তবে আমাদের সরকার কি এ হত্যাযজ্ঞের নিন্দা
করবে না? সংঘাতের শিকার হওয়া লাখো মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনা নিয়ে আমরা কি ভাবিত হব
না? আমরা
কি সহিংসতা রোধে আমাদের উত্তম সেবা দিতে চাইব না, অন্তত তেমন প্রচেষ্টা যারা নেবে তাদের
সহায়তা করব না?’
শুধু তা-ই নয়, দেশ
স্বাধীন হওয়ার পরে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য মার্কিন
সিনেটর স্যাক্সবি উত্থাপিত প্রস্তাবের সমর্থক হলেন এই এডওয়ার্ড কেনেডি।
তিন.
একাত্তরের অকৃত্রিম বন্ধু জোয়ান
বায়েজ। আমেরিকান লোকশিল্পী,
গীতিকার ও সামাজিক কর্মী। তিনি তখন পর্যন্ত
বাংলাদেশ দেখেননি, শুধু শুনেছেন বাংলাদেশের
(পূর্ব পাকিস্তান) কথা, শুনেছেন এ দেশের মানুষকে নির্বিচারে
গুলি করে হত্যা করে হচ্ছে, হত্যা করছে পাকিস্তানিরা। এ বার্তা জোয়ান বায়েজের কাছে ছিল। সেই বার্তা
জোয়ানের কথায় হয়ে ওঠে অনন্যসাধারণ গান। আমার মতে, মুক্তিযুদ্ধের ওপর যতগুলো গান বা
কবিতা রচিত হয়েছে, তার মধ্যে এ গানটির আবেদন সবচেয়ে বেশি। যখনই তার ‘সং
অব বাংলাদেশ’ গানটি শুনি, তখনই মনে হয় কতটা দরদ দিয়ে,
কতটা অনুভূতি দিয়ে তিনি একটি অচেনা, অজানা
দেশের জন্য গেয়ে উঠেছেন, ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ/
বাংলাদেশ বাংলাদেশ/ অস্তাচলে
যেখানে দিন শেষ,/ লাখো প্রাণের রক্তে রাঙা দেশ।’
একটা দেশের জন্য কতটা ভালোবাসা থাকলে
এভাবে গান গাওয়া যায় তা আমার জানা নেই,
তবে আমি জানি, এ মহান শিল্পী আমাদের বন্ধু, আমাদের
মিত্র। তাদের শক্তিতে আমরা বলশালী হয়ে উঠেছিলাম, চেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ।
বিনয় দত্ত: কথাসাহিত্যিক
ও সাংবাদিক