ব্রেক্সিটের জয়, উদারতার পরাজয়

হুমায়ুন কবির

অবশেষে ব্রেক্সিটের পক্ষেই মত দিল ব্রিটেন। সদ্যসমাপ্ত আগাম নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি। ১৯৮৭ সালের পর এটিই দলটির জন্য সবচেয়ে ভূমিধস বিজয়। ব্রিটিশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বড় অংশের মতে, এ জয় কার্যত কনজারভেটিভ পার্টির নেতারাও অনেকে আশা করেননি। এমনকি লেবার পার্টির দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বলে পরিচিত বেশকিছু জায়গায়ও থাবা বসিয়েছেন কনজারভেটিভরা। সেদিক থেকে এ নির্বাচনকে নজিরবিহীনই বলতে হবে।

অন্যদিকে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত লেবার পার্টি আসন পেয়েছে মাত্র ২০৩টি আসন। কম আসনপ্রাপ্তির দিক থেকে এটি দলটির ১৯৮৩ সালের আগের রেকর্ডও ছাড়িয়েছে। ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বাভাবিকভাবে দলটির প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেরিমি করবিন, যদিও তিনি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য আপাতত আলোচ্য পদে থাকছেন। পদত্যাগ ঘোষণার সময় তিনি বলেছেন, ‘ঐক্যের ইশতেহার এখনো জনপ্রিয়। কিন্তু তবু ব্রেক্সিটের পক্ষে সমর্থনের বিশাল ঢেউয়ের কাছে সেই নীতির হার হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার জন্যব্রেক্সিট প্রশ্নেই উল্লিখিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রিটেনে। কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় ব্রেক্সিট বিল অনুমোদনে কোনো সমস্যা হবে না। ব্রেক্সিটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি। কাজেই আলোচ্য সিদ্ধান্ত কার্যকরে আর কোনো অনিশ্চয়তা বা দোলাচল থাকছে না।

উল্লেখ্য, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়ার আগে ২৬৬ বছর ব্রিটেন স্বাধীন ও এককভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পর ৪৬ বছর পার হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো বা অভিন্ন ভিসা সেনজেনেও ব্রিটেন কখনো যোগ দেয়নি। যে বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল ব্রিটেন, তার অনেকখানিই এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশ গত এক দশকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। দেশগুলোর লাখ লাখ কর্মহীন মানুষের চাপে ব্রিটেন নাগরিকদের চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ থেকে আসা নিত্যপণ্যের ওপর ব্রিটেন অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু ব্রিটেনে রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৃষকরা রাস্তায় হাজার হাজার লিটার দুধ ফেলেন, উত্পাদিত শাকসবজি ফেলে প্রতিবাদ করেছেন।

ব্রিটেনের ২০১৫ সাল থেকে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইস্যু ব্রেক্সিট। ব্রিটেন ইউরোপে থাকবে কিনা, এই ইস্যুতে জনরায় জানতে ২০১৬ সালের ২৩ জুন দেশটিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সে গণভোটে ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ জনগণ ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পক্ষে রায় দেয়। ২০১৭ সালের নির্বাচনেও ব্রেক্সিটের পক্ষের দল কনজারভেটিভ পার্টি আবারো সরকার গঠনে সক্ষম হয়। গণভোটে ব্রিটিশ জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে রায় দিলেও দেশটির এমপিরা সে রায় বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ান। ব্রেক্সিট নিয়ে বারবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন খোদ সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাই। লেবার পার্টি তো বটেই, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলেরও বহু এমপি-মন্ত্রী ব্রেক্সিট নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মন্ত্রিসভা, এমনকি দলও ত্যাগ করেছেন। অনেকে নতুন দল গঠন করেছেন।

ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের অবাধ স্বাধীনতার সৌন্দর্যের উল্টোপিঠের অস্থিরতায় আক্রান্ত এখন দেশটির রাজনীতি। এমন অস্থিরতার ফলে সরকার যেমন দুর্বল হতে থাকে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল হতে থাকে পাউন্ড, যার ধাক্কা লাগে দেশটির অর্থনীতিতেও। ব্রেক্সিট ডিল বারবার পিছিয়ে যাওয়ায় দেশটির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। এখন সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের মাধ্যমে এর একটা সুরাহা হবে বলে আশা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এবারের নির্বাচনী ফলাফল ব্রিটেনের ভবিষ্যত্ রাজনীতির গতিমুখ বোঝার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের ধরনে ভৌগোলিক অবস্থানগত প্রভাব ছিল। দেশটির মিডল্যান্ড, নর্থ ইস্ট ও ইয়র্কশায়ারে কনজারভেটিভদের সমর্থন ৪ শতাংশ বেড়েছে। উল্লিখিত অঞ্চলগুলোয় ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছে মানুষ। বিপরীতভাবে, নর্থ ইস্ট ও ইয়র্কশায়ারে লেবার পার্টির ভোট কমেছে ১২-১৩ শতাংশ; যেখানে লন্ডন এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণাংশে কমেছে মাত্র ৬-৭ শতাংশ। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, এ নির্বাচনে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোট বেড়েছে। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভোট দিয়েছে লেবার পার্টির পরিবর্তে টরি পার্টিকে। এমনকি লেবার পার্টি ঐতিহ্যগতভাবে বারবার বিজয়ী হওয়া শ্রমজীবী অধ্যুষিত এলাকাগুলোয়ও নিজেদের ভিত্তি হারিয়েছে এবার। এটি খুব ইঙ্গিতবাহী। কনজারভেটিভ পার্টির বিজয় ব্রিটেনের আপাত অচলাবস্থার অবসান ঘটাবে বটে, কিন্তু দেশটির ভবিষ্যত্ উদার গণতন্ত্রের জন্য এটি এক অর্থে হুমকি হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। সন্দেহ নেই, এর মধ্য দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদেরই জয় হলো। এটি অবশ্য চলমান বৈশ্বিক প্রবণতার বাইরের কোনো বিষয় নয়। বিশ্বব্যাপীই এমনটি ঘটছে। ব্রিটেনের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল এতে একটি বাড়তি পালক সংযোজন করেছে মাত্র।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন