চেরনোবিল ট্র্যাজেডি

জীবিত ও মৃত শহরের পথে পথে

শিহাবুল ইসলাম

স্লাভুটিচের বিশাল কেন্দ্রীয় চত্বরের ওয়াচ টাওয়ারটিতে প্রতি ঘণ্টায় সংগীত বেজে ওঠে। এক নিমেষে খান খান হয়ে যায় চারপাশের নীরবতা। শান্ত স্কয়ারটি স্মরণ করিয়ে দেয় উত্তর ইউক্রেনের এ শহরটি জীবিত। এ বেঁচে থাকার ঘোষণাটি এখানে খুব গুরুত্ব বহন করে, কারণ শহরের অনেক নাগরিক দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ানক পারমাণবিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে। চেরনোবিল বিস্ফোরণ জন্ম দিয়েছিল এ স্লাভুটিচ শহরের।

১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে চেরনোবিলের পরমাণু চুল্লিতে। আর এ ঘটনায় ধ্বংস হয়ে যায় প্রেপিয়াত শহর। শহরটির ৪৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। জীবন্ত প্রেপিয়াত পরিণত হয় এক ভুতুড়ে শহরে। বিস্ফোরণের পর মানুষজন যখন প্রেপিয়াত ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন সোভিয়েত কর্মকর্তারা তাদের বলেছিলেন, তারা তিনদিন পরই নিজেদের ঘরে ফিরতে পারবে। কিন্তু তারা আর কোনোদিনই ফিরতে পারেনি। দুর্ঘটনার পর প্রেপিয়াত মরে গিয়েছিল। কিন্তু এত বড় বিপর্যয়ের পরও চেরনোবিল পাওয়ার প্লান্ট চালু রাখা হয়েছিল। তিনটি চুল্লি চালু রাখতে কর্মীদের বসবাসের জন্য নতুন আবাসন তৈরির প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। এ প্রয়োজন থেকেই জন্ম হয় স্লাভুটিচ শহরের।

চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জাদুঘরে কাজ করা খ্রিস্টিনা বেলচেঙ্কোর কথায়, শহরটি তৈরির জন্য তিনটি প্রধান মানদণ্ড ছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরে হওয়া যাবে না, বিদ্যমান রেলপথ থাকতে হবে এবং দূষণমুক্ত অঞ্চল হতে হবে। এ মানদণ্ডগুলো বিবেচনায় নিয়ে জায়গা হিসেবে বেছে নেয়া হয় পাইনের ঘন বনের মাঝখানে একটি জনশূন্য রেলস্টেশনকে।

১৯৮৬ সালের শেষদিকে নতুন শহর তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর পরই কাজ শুরু হয়। সোভিয়েত নির্মাণ সংস্থানগুলো অবিশ্বাস্যভাবে সমন্বয় করে কাজ করে এবং দুই বছরের মধ্যেই স্লাভুটিচকে বাসযোগ্য করে তোলা হয়।

১৯৮৮ সালের শেষদিকে শহরটি চালুর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে সর্বোচ্চ মানের জীবনযাপনের ব্যবস্থা করেছিল। আজও শহরের এক অংশ থেকে অন্য কোথাও হাঁটতে গেলে বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের মতো মনে হয়। ঐতিহ্যবাহী টিবিলিস্কি কোয়ার্টারের ব্যালকনিতে আছে জর্জিয়ার ঐতিহ্যবাহী ক্রুশ। এছাড়া ইয়রেভানস্কি কোয়ার্টারের ঘরগুলো আর্মেনিয়ার পিংক হাউজের আদলে তৈরি করা। স্লাভুটিচে পৃথক বাইক লেন আছে, যা ইউক্রেনের আজকের দিনের বেশির ভাগ শহরে নেই। বেলচেঙ্কো বলেন, এ শহরটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ স্মৃতিস্তম্ভ বলা হয়।

প্রেপিয়াত শহরেই জন্ম কুজনেেসাভার। ১১ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২৭ এপ্রিল সবার সঙ্গে তিনিও এ শহর ত্যাগ করেন। কয়েকদিনের জন্য তারা এ শহরের বাইরে যাচ্ছেন, সেভাবেই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু অনেকের মতো তাদেরও আর কখনো ফেরা হয়নি। সে সময় তার পরিবার প্রাথমিকভাবে মডোভার কিশিনভে বসতি স্থাপন করেছিল। প্রেপিয়াত থেকে সরিয়ে নেয়া মানুষদের কিশিনভ শহরে বাড়ি দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৯০ সালে তার বাবার চেরনোবিলে কাজের জন্য ইউক্রেনে ফেরত আসতে হয় এবং নতুন শহর স্লাভুটিচে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়।


আজ প্রেপিয়াত পৃথিবীর একটি বিখ্যাত মৃত শহর। এখানে জঙ্গল গজিয়ে ওঠা পথঘাট, পরিত্যক্ত ভবনগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। এ বছর এইচবিও চ্যানেলে প্রচারিত চেরনোবিল সিরিজ এ শহরের প্রতি মানুষের আগ্রহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

কুজনেেসাভা বলেন, ১৯৯২ সালে যখন প্রথমবারের মতো আমি বাবার সঙ্গে প্রেপিয়াতে যাওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে যখন বাস থেকে নামলাম, তখন বুঝতে পারছিলাম না যে ঘাসগুলো কীভাবে এত বড় হতে পারে। আমরা সেখানে ১৫ মিনিট অবস্থানের অনুমতি পাই। পরের বছর আমি মায়ের সঙ্গে প্রেপিয়াতে গিয়েছিলাম এবং আমরা নিজেদের বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিলাম। আটতলায় গিয়ে আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল আমরা বর্তমান ও অতীতের মাঝে দাঁড়িয়ে। আমি বুঝতে পারছিলাম দরজার ওপাশে সাত-সাতটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমি দরজা খুলতে পারিনি, সেটা খুব বেদনাদায়ক ও ভীতিকর হতো।

সেই থেকে কুজনেেসাভা নিয়মিত প্রেপিয়াতে যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, আমি যখন সেখানে যাই, তখন প্রায় নিরাময় হয়ে যাওয়া ক্ষততে লবণ ছিটিয়ে দেয়ার মতো মনে হয়। সেখানে পৌঁছার পর আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না।

অনেকের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্লাভুটিচের নতুন জীবন শেষ হয়। চেরনোবিলের চুল্লিগুলো সক্রিয় থাকতেই ২০০০ সালের ডিসেম্বরে এটি চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। পারমাণবিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রেপিয়াতের প্রায় ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। এরপর স্লাভুটিচ চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্যাটেলাইট শহরে রূপ নেয়।

স্লাভুটিচ শহরে বছরে একবার ফেস্টিভ্যাল অব ফিল্ম অ্যান্ড আরবানিজম নামে একটি উৎসব হয়, যা৮৬ নামে খ্যাত। এটি ছাড়াও বছরজুড়ে এ শহরে আরো অনেক শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক অনুষ্ঠান হয়।

স্লাভুটিচ শহরে কোনো গণপরিবহন নেই, তবে নির্দিষ্ট ভাড়ার ট্যাক্সি আছে। শহরটি ফাঁকা ফাঁকা মনে হলেও অনেক জায়গায় শিশুদের দেখা যায়। এ শহরে ঘুরলে ভ্রমণের মতো অনুভূতি লাগে।

১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৃথিবীর ভয়াবহতম পারমাণবিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় ৩২ জন নিহত হয়; বিস্তীর্ণ এলাকায় শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পরবর্তী সময়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারদিকে ৩০ মাইল এলাকায় মানুষের বসবাস নিষিদ্ধ করা হয়, যা এখনো বলবৎ। বিশেষজ্ঞদের মতে, চেরনোবিল মানুষের বসবাসের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ হতে সময় লাগবে কমপক্ষে ২০ হাজার বছর। এ এক অদ্ভুত শহর, জীবন্মৃত স্মৃতিদের দুঃখ চেপে হাতড়ে খোঁজার শহর, চেরনোবিল।

 

সূত্র: সিএনএন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন