নৈতিকতা প্রশ্নে র‍্যান্ডমাইজড দারিদ্র্য বিমোচন নিরীক্ষণ

পিটার সিঙ্গার, আর্থার বেকার, ইয়োহানেস হাউসহফার

স্বল্প আয়ের দেশগুলোয় দারিদ্র্য মোকাবেলায় র‍্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালস (আরসিটি) ব্যবহারের তিন অগ্রপথিককে গত অক্টোবরে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। তারা হলেন অভিজিৎ ব্যানার্জি, এস্তার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার। আরসিটিতে হস্তক্ষেপ গ্রহণে গবেষকরা একদল মানুষকে এলোমেলোভাবে পছন্দ করেন এবং একটি কন্ট্রোল গ্রুপকে বিবেচনায় রাখেন, যাদের সাধারণত এলোমেলোভাবে পছন্দ করা হয় না। পরে উভয় গোষ্ঠীর সুফল বা ফলাফল (আউটকাম) তুলনা করা হয়। চিকিৎসা গবেষকরা এ পদ্ধতি নতুন ওষুধ বা শল্য কৌশল (সার্জিকেল টেকনিকস) পরীক্ষায় ব্যবহার করেন আর দারিদ্র্যবিরোধী গবেষকরা অন্য পদ্ধতির সঙ্গে আলোচ্য পদ্ধতি ব্যবহার করেন কোন ধরনের নীতি বা হস্তক্ষেপ সবচেয়ে কার্যকর, সেটি যাচাইয়ের জন্য। অভিজিৎ ব্যানার্জি, দুফলো, ক্রেমারসহ অন্যদের চমত্কার গবেষণাকর্মের জন্য অভিনন্দন। কেননা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরসিটি এখন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার ও উপকরণে পরিণত হয়েছে।

তবে আরসিটির ব্যবহার কিছু নৈতিক প্রশ্নও সামনে এনেছে। কারণ এ পদ্ধতিতে এলোমেলোভাবে একদল জনগোষ্ঠীকে পছন্দ করা হয়, যারা নতুন ওষুধ বা আর্থিক সহায়তা পায়। আবার কন্ট্রোল একটি গ্রুপ বিবেচনায় রাখা হয়, যারা কোনো ধরনের সহায়তা বা হস্তক্ষেপ পায় না। সেদিক থেকে শেষোক্ত দলটি নিজেদের হীনতর (ইনফেরিয়র) মনে করতে পারে। প্রভাবশালী জার্মান দার্শনিক কান্টের যুক্তি অনুসরণ করে আলোচ্য মূলনীতি নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। কান্টের মতে, কোনো এক উদ্দেশ্যের উপায় হিসেবে মানুষকে ব্যবহার করা সবসময়ই খারাপ কাজ হিসেবে বিবেচিত। সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছেন, ‘জানার বিনিময়ে আরসিটিতে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কল্যাণ জলাঞ্জলি দেয়া হয়।

এ যুক্তির ভিত্তিতে সব ধরনের আরসিটি প্রত্যাখ্যান করলে অবশ্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও বাদ যাবে, নতুন চিকিৎসা উন্নয়নে যার ওপর আধুনিক ওষুধগুলো নির্ভর করে। আরসিটিতে কন্ট্রোল ও ট্রিটমেন্ট উভয় গ্রুপে অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়এ গবেষণা আনুমানিক, এতে স্বেচ্ছায় সই করতে হবে, অংশ নিতে হবে এবং যেকোনো সময় বাদ যেতে পারে। উল্লিখিত নেতিবাচকতা সত্ত্বেও এ ধরনের নিরীক্ষায় অংশগ্রহণে নিজেদের পছন্দ থেকে মানুষকে প্রতিরোধ করা হবে অত্যধিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘনের সমতুল্য। 

একটি তুলনামূলক কম কট্টর সমালোচনায় বলা হয়, যদিও চিকিৎসার সুফল (ট্রিটমেন্টস মেরিট) সম্পর্কে বাস্তব ও প্রকৃত সংশয় জাগলেই কেবল মেডিকেল আরসিটিগুলো পরিচালনা করা হয়, তার পরও উন্নয়নসংক্রান্ত কর্মযজ্ঞে ব্যবহূত ক্যাশ ট্রান্সফারের মতো অনেক উন্নয়ন আরসিটি নিরীক্ষা হস্তক্ষেপ পরিষ্কারভাবে কিছু না হওয়ার চেয়ে অধিকতর ভালো। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কাউকে শুধু চিকিৎসা দেয়া কি নৈতিক হতে পারে?

এ সমালোচনা দুটি বিবেচনাকে উপেক্ষা করে। প্রথমত. এটি সবসময়ই পরিষ্কার নয় কোন নীতি বা হস্তক্ষেপ অধিক ভালো। উদাহরণস্বরূপ, আরসিটির সুফলের প্রমাণ সামনে আসার আগে ভয় ছিল যে, ক্যাশ ট্রান্সফার মানুষের মধ্যে সংঘাত ও মাদকাসক্তি সৃষ্টি করবে।

দ্বিতীয়ত, অনেক উন্নয়ন বিন্যাসে একটি স্বাভাবিক কন্ট্রোল গ্রুপ সৃষ্টির মাধ্যমে সবাইকে সাহায্যের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ নেই। অনুরূপভাবে সম্পদ অপ্রতুল একটি বিশ্বে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, কোনো কিছু না হওয়ার চেয়ে কোনো একটা হস্তক্ষেপ ভালো কিনা। দাতা ও নীতিনির্ধারকদের জানতে হবে সুনির্দিষ্ট হস্তক্ষেপ কতটা ভালো এবং সেটি কিসের মূল্যে ও বিনিময়ে। এভাবে উন্নয়ন আরসিটিগুলো হস্তক্ষেপজনিত প্রভাবের ব্যাপ্তি ও ব্যয়সহ অনিশ্চয়তার একটি বৃহত্তর ধারণা ব্যবহার করে। টেকসই বিকল্পের চেয়ে গবেষণাধীন চিকিৎসা যদি বেশ ব্যয়বহুল হয় এবং তা থেকে কম লোকই উপকার পায়, তাহলে সেটি অনৈতিক হবে।

নৈতিক আপত্তির তৃতীয় ধরন হলো, আরসিটি দ্বারা আসলে অংশগ্রহণকারীরা ক্ষতির শিকার হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্যাশ ট্রান্সফার মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং অসুবিধাভোগীদের (নন-রিসিপিয়েন্ট) দরিদ্র করা কিংবা তাদের ঈর্ষান্বিত ও অখুশি করার কারণ হতে পারে। এসব প্রভাব এমনকি তাদেরও প্রভাবিত করতে পারে, যারা কখনো কোনো গবেষণায় অংশ নিতে সম্মত হননি।

এটি সম্ভবত সবচেয়ে ভয়াবহ সমালোচনা, কিন্তু এটিও সাধারণ অর্থে আরসিটিকে পুরোপুরিভাবে অনৈতিক প্রতিপন্ন করে না। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কিছুটা ক্ষতিজনিত ঝুঁকি থাকবে, তা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। এথিকস রিভিউ বোর্ড গবেষণাগুলোর ঝুঁকির বিপরীতে তাদের সম্ভাব্য সুফলের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। চিকিৎসা গবেষণাও অনেকটা একই ধরনের। চিকিৎসকদের চিকিৎসাচর্চায় অনুসরিতকারো কোনো ক্ষতি নয় নীতি গবেষণা নিরীক্ষণেঝুঁকি কমিয়ে সুফল বাড়ানোর একটি দুর্বল শর্ত দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীদের সেগুলো সম্পর্কে বলে দেয়া হয়, যাতে তারা আদৌ সামনে এগোবে কিনা, তা নিয়ে একটি সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

নোবেলজয়ী আরেক অর্থনীতিবিদ আঙ্গাস ডিটন সম্প্রতি বলেছেন (অন্যরাও বলেছেন), কিছু দারিদ্র্যবিরোধী আরসিটিতে এমন মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যারা নিজেরা জানেন না যে তারা নিরীক্ষার অংশ, কিন্তু তবু তারা ক্ষতির শিকার হতে পারেন। এটি বাড়তি নৈতিক উদ্বেগ সামনে আনে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করা উচিত, এসব আরসিটি প্রায় ক্ষেত্রে কতগুলো টেস্ট প্রোগ্রামসরকার, এনজিও ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে কীভাবে এসব কর্মসূচি অসুবিধাভোগীদের প্রভাবিত করে কিংবা আদৌ করে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, একটি আরসিটি যদি খুঁজে পায় যে, কোনো হস্তক্ষেপ ভয়াবহভাবে অসুবিধাভোগীদের ক্ষতি করে, তখন আলোচ্য হস্তক্ষেপ সম্প্রসারণ প্রতিরোধ করা গেলে বিপুল ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, অসুবিধাভোগী বা অংশগ্রহণ না করাদের কিছুটা ক্ষতি করা এবং নীতিনির্ধারক কর্তৃক সরাসরি বাস্তবায়ন না হওয়া টেস্ট প্রোগ্রামগুলোও অনুমোদনযোগ্য হতে পারে, যদি সেগুলোর সৃষ্ট সুফল সন্দেহাতীতভাবে এর ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যায়। দার্শনিক ডেরেক পারফিট প্রশ্ন তোলেন, একটি শিশুর জীবন বাঁচাতে ধসে পড়া ভবনে আটকে পড়া একজন ব্যক্তি আদৌ একজন অসচেতন আগন্তুকের পায়ের আঙুল ভাঙতে পারেন কিনা। অধিকাংশই সম্মত যে এক্ষেত্রে আগন্তুককেব্যবহার নৈতিকভাবে অনুমোদনযোগ্য। একইভাবে আরসিটি কদাচিৎই হস্তক্ষেপগুলো চিহ্নিত করেছে, যা অন্যদের চেয়ে দশ কিংবা হাজার গুণ কার্যকর। এসব ফলাফল বা অনুসন্ধান সবচেয়ে কার্যকর হস্তক্ষেপগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো বা জীবনমান উন্নয়নে সমর্থ করে তুলবে। কাজেই আরসিটি নৈতিকভাবে অনুমোদনযোগ্য এবং আমরা বলি যে এমনকি নৈতিকভাবে এটি প্রয়োজনীয়ও বটে।

তদুপরি উন্নয়নশীল দেশগুলোয় আরসিটির নীতি-নৈতিকতা সূক্ষ্ম। কিছু সমালোচক তর্ক তুলেছেন, তত্ত্বগতভাবে যদিও আরসিটি নৈতিক হতে পারে, বাস্তবে সেগুলো তা নয়। কাজের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার তাত্পর্যজনক বৈসাদৃশ্য-অসামঞ্জস্য রয়েছে; যেখানে গবেষকরা সাধারণত ধনী দেশগুলো থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর নিরীক্ষা পরিচালনা করেন। নিজস্ব দেশ ও গবেষণা পরিচালনাধীন ভূখণ্ড উভয় দেশের স্বতন্ত্র এথিকস রিভিউ বোর্ড থেকে গবেষকদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।        

নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষাকবচ; যেহেতু এটি বাইরে থেকে আরোপিত নৈতিক মান নিশ্চিত করে। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ওয়াইবলা ওকুনোগবে সম্প্রতি বলেছেন, যদি এসব স্থানীয় তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা না যায়, গবেষকদের তাদের গবেষণার নৈতিকতা স্থানীয়ভাবে যাচাইয়ের অন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের অঙ্কুর সারিন পরামর্শ দিয়েছেন, এথিকস রিভিউ বোর্ডের নিজস্ব গৃহীত সিদ্ধান্তের জনসমক্ষে ব্যাখ্যা দেয়া উচিত। আমরা মনে করি, দুটিই ভালো পরামর্শ।

উন্নয়নশীল দেশের গবেষকদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিক্ষামূলক সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতির নতুন নোবেলজয়ীরা একটি সমাধান যাত্রায় ভূমিকা রাখছেন। ব্যানার্জি ও দুফলোর সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত এমআইটির একটি নতুন প্রোগ্রামে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য একটি পুরোপুরি অর্থায়নকৃত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়, যারা একটি অনলাইন কোর্সে তাদের সম্ভাবনা বা নৈপুণ্য দেখাতে সমর্থ। এজন্য তাদের কোনো স্কুল ডিপ্লোমারও প্রয়োজন হয় না। 

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

পিটার সিঙ্গার: প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োএথিকসের অধ্যাপক

আর্থার বেকারসেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের গবেষণা সহযোগী

ইয়োহানেস হাউসহফার: প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সহকারী অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন