নুরুন্নাহার মাসুদ। দ্বিতীয় কোনো
পরিচয়ের হয়তো প্রয়োজন নেই; তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আকাশের ধ্রুবতারা তারেক মাসুদের মা।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরপুর গ্রামের যে বাড়ির আঙিনায় ঘুমিয়ে আছেন তারেক মাসুদ, সেই
বাড়িতেই তার বসবাস। দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি কাটান প্রিয় সন্তানের সমাধিস্থলকে
চোখে চোখে রেখে। গতকাল টকিজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখনো
তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তারেকের সমাধির সামনে। আজ চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক
মাসুদের ৬৩তম জন্মদিন উপলক্ষে তার মা নুরুন্নাহার মাসুদের সঙ্গে টকিজের সে কথোপকথন
তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুবেল পারভেজ
আগামীকাল
(আজ)
আপনার সন্তান তারেক মাসুদের
৬৩তম জন্মদিন...
কোনো উপলক্ষ কিংবা মুহূর্ত নয়, তারেককে
নিয়ে কথা বলতে পারলেই শান্তি পাই। আমার বুকের ধন, আমার প্রিয় তারেক, তোকে ছাড়াই তোর জন্মোৎসব,
এ তো আমি চাইনি! আমার সবসময় মনে হয়, তারেক
বেঁচে আছে। এ কথা ও আমাকে নিজেই বলেছিল স্বপ্নে দেখা দিয়ে। মাটি দেয়ার পর তারেক স্বপ্নে
এসে আমাকে ডেকে কাছে বসিয়েছিল। বললাম,
‘তারেক কী হয়ে গেল বাবা তোমার? তোমাকে
যারা ভালোবাসে, সেই
তারাই তোমাকে মাটির ভেতরে শুইয়ে দিয়ে গেল?’
আমার প্রশ্নে বলল, ‘আম্মা
কিছু জানি না, আমি
বেঁচে আছি।’
তো কই, ‘আমি
তো তোমাকে খুঁজছি, কোথায়
তুমি?’
এই তো কয়েক দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ নামের যে চলচ্চিত্র সংগঠনটি আছে, ওদের
আয়োজনে গিয়ে মনে হয়েছিল, আমার
তারেক এ অনুষ্ঠানের মধ্যেই আছে। আসলে এ অনুভূতি নিয়ে আমি বেঁচে আছি।
নতুন প্রজন্মের মাঝে তারেক মাসুদের ছায়া দেখেন কতটা?
মা বলুন আর দর্শক বলুন—আমি বিশ্বাস করি, তারেক
যে ছবিগুলো বানিয়ে গেছে, সেসব
ছবি দেখে শত শত তারেক তৈরি হবে। একজন মা হিসেবে এটা আমার কাছে আনন্দের ব্যাপার। আমি
মনে করি, তারেক
যা করে গেছে, তারেক
যে স্বপ্ন দেখে গেছে, নতুন
প্রজন্ম অক্ষরে অক্ষরে তা পূরণ করছে। এই দূর গ্রামে এখনো নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা
আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, তারেকের
প্রতি তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আমি ওদের ভেতর তারেকের ছায়া দেখতে পাই।
আপনি তার সিনেমা দেখেন এখনো?
তারেক আমাকে ওর সিনেমা আগে দেখাত, আমাকে
ও হলেও নিয়ে গেছে। মাটির ময়না দেখেছি, মুক্তির গান যখন আনল তখন দেখেছি। এখন তো দেখার
মতো তেমন সুযোগ পাই না। তবে তারেককে নিয়ে ফেরা নামের যে ছবিটা আছে, ওটা দেখলে
মনে হয়, আমার
তারেক বেঁচে আছে। ছবিটা দেখতে বড় ভালো লাগে আমার।
তার বানানো সিনেমা দেখার পর কেমন বোধ করেন?
আমি গর্বিত বোধ করি। ওর ছবি দেখে মনে হয়, এত কষ্ট
করেছে আমার বুকের ধন! ও
জীবিত থাকতে কেন বুঝিনি। এখন তিলে তিলে বুঝতে পারছি। সত্যি বলতে কি, তারেক
যে এত বড় মাপের নির্মাতা হয়ে যাবে তা বুঝিনি। কিন্তু এত বড় হয়েও তো কিছু হলো না। শেষ
পর্যন্ত চলেই গেল। আমার মনে হয়,
তারেক যদি এত বড় মাপের পরিচালক না হতো, তাহলে
বোধহয় আমার সন্তানকে বুকে নিয়ে আমি আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকতে পারতাম।
নিজের সন্তানের ছবি নিয়ে যখন দেখেন কোথাও আলোচনা
হচ্ছে...
মা হিসেবে শান্তি পাই। যারা ওকে নিয়ে, ওর ছবি
নিয়ে চর্চা করে, যারা
আমার তারেককে বাঁচিয়ে রাখছে,
তাদের জন্য আমি দোয়া করি। তারাও আমার সন্তানের মতো।