বাঙালির বছর বারো মাসে—বৈশাখ থেকে চৈত্র। সরকারি বছর বারো মাসে—জুলাই থেকে জুন। আর ইংরেজি ক্যালেন্ডার বছরও বারো মাসে—জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর। কিন্তু কেউ কি জানেন, এ বাংলাদেশে এর চেয়ে ছোট-বড় বছর আছে। সেখানে বারো মাসে বছর হয় না। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতে কম-বেশি সময় লাগে। একই সময়ে পৃথিবী তা করে না বা পারে না। প্রশ্ন, এসব বছর কোথায়? আমি অন্তত দুটোর সন্ধান পেয়েছি। এর বাইরে আছে কিনা আমার জানা নেই। আমার জানামতে দুটো বছরের একটি কিশোরগঞ্জে মহামান্য রাষ্ট্রপতির জেলায়। আর অন্যটি সারা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয়। কিশোরগঞ্জ জেলায় বছর হয় আট মাসে। আর ব্যাংকের ক্ষেত্রে বছর হয় ১৩ মাসে। বিচিত্র খবর নয় কি? নয় কি অবিশ্বাস্য দুটো খবর? অথচ এটা সত্য, বাস্তব সত্য। কিশোরগঞ্জের বেলায় বহুদিন ধরে। আমরা যখন ছোট, তখনো এর কথা শুনেছি, দেখেছি। আর ব্যাংকের বেলায় তেরোমাসি বছরের আবিষ্কার ইদানীংকালের। মজার বিষয়, একটি ঋণের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যটি আমানতের (ডিপোজিটের) সঙ্গে সম্পর্কিত। উভয় ক্ষেত্রে একটি বিষয় সমান। উভয়ই ‘মহাজন’। একজন পুরনো কালের। আরেকজন ইদানীংকালের ভদ্রবেশী ‘মহাজন’। একজন জোতদার-বড় কৃষক-সুদি ব্যবসায়ী; অন্যজন ব্যাংকার। উভয়ই তাদের স্বার্থরক্ষার্থে নিজস্ব গতিতে চলে। ঋণের ক্ষেত্রে যত নিয়ম-আইন সব তাদের পক্ষে। আবার ‘আমানতের’ ক্ষেত্রেও নিয়মকানুন তাদের পক্ষে। কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলের কৃষকরা, ছোট কৃষকরা ঋণে জর্জরিত সবসময়। তাদের একবছরী ফসল প্রায়ই মার খায়। অকালবন্যা, বন্যা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি কারণে তাদের ফসল প্রায়ই মারা যায়, তারা পড়েন মহাবিপদে। কে বাঁচাবে তাদের? একমাত্র ভরসা ‘মহাজন’, যিনি
প্রায়ই বড় কৃষক-জোতদার। তার সম্পর্ক রাজনীতির সঙ্গে, প্রশাসনের সঙ্গে, শহরাঞ্চলের ভদ্রলোক ও ক্ষমতাধর লোকদের সঙ্গে। এ মহাজন হতভাগ্য কৃষকদের ত্রাণদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ঋণ দেন। এ ঋণ বার্ষিক ভিত্তিতে নয়। কয়েক দিন আগে একটি দৈনিকে এ সম্পর্কে তাজা খবর ছাপা হয়েছে। প্রাচীনকালের খবর, নতুনভাবে ভদ্রলোকদের জন্য পরিবেশিত। কী খবর? এতে বলা হয়েছে ‘মহাজনী ঋণে ১ হাজার টাকায় ৫০০ টাকা সুদ দিতে হয় আট মাসে। সুদের হার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ (আট মাসে বছর)।’ এই যে খবর, এতে লুকিয়ে আছে ভাটি অঞ্চলের, এমনকি অন্যান্য সমতল অঞ্চলের সাধারণ কৃষকের কান্না, বুকভরা কান্না।
আমার মনে আছে স্কুলে থাকতে একই হারে গ্রামে বড় কৃষকের কাছ থেকে আমরাও ঋণ নিয়েছিলাম। বড় সুদে সেই ঋণ শোধ করেছি লেখাপড়া শেষ করে। এ দুঃখের কথা কত লোকে কত সময়ে বলল, কত বক্তৃতা হলো, কত লোক এসব বলে সংসদ সদস্য হলেন, হলেন কত কিছু; কিন্তু গ্রামের, ভাটি অঞ্চলের অসহায় কৃষকদের দুঃখ আর গেল না! ‘আবিষ্কার’ হলো ‘এনজিও’র। গ্রামে গেল অনেক ব্যাংক। সবারই অঙ্গীকার তারা ঋণ দেবে সহজ শর্তে, কম সুদে, কৃষককে না ভুগিয়ে। কিন্তু কই, এখনো তো সেই একই কান্না, একই হাহাকার। মানুষ, দরিদ্র মানুষ, দরিদ্র কৃষকের সামনে ফসল। এখন হাতে টাকা নেই। সে ফসল কম দামে অগ্রিম বিক্রি করে দেয় নগদ টাকার বিনিময়ে, ঋণের বিনিময়ে। শতশত লোক হয় ‘বন্ধকি শ্রমিক’ (বন্ডেড লেবার)। আশ্চর্য লাগছে? যাদের তা লাগে, তারা ভাটি অঞ্চল ঘুরে আসতে পারেন। উল্লিখিত সংবাদটিতে ?