গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে সিনিয়র কর্মকর্তা ছাড়াই চলছে ডিএসইর কার্যক্রম

মেহেদী হাসান রাহাত

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) শেয়ারবাজারে হওয়া মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি এক্সচেঞ্জটির দখলে। গুরুত্বপূর্ণ এই স্টক এক্সচেঞ্জটিতে বর্তমানে কোনো পূর্ণকালীন প্রধান নির্বাহী নেই। পাশাপাশি প্রধান পরিচালন কর্মকর্তাসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে মহাব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপকের মতো সিনিয়র কর্মকর্তা ছাড়াই চলছে এক্সচেঞ্জটির কার্যক্রম। এতে সুষ্ঠুভাবে এক্সচেঞ্জটির কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথকীকরণ) পর ২০১৩ সাল থেকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালিত হচ্ছে। ডিএসইতে বর্তমানে কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন ৩৬৫ জন। অবশ্য এর মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে নির্বাহী পর্যায়ের কর্মকর্তা। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, ডিএসইতে একজন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) থাকার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক্সচেঞ্জটিতে কোনো সিওও নিয়োগ দেয়া হয়নি। ডিএসইতে ছয়টি ডিভিশনের আওতায় ৩৫টি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন (এমডিডি) ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন (আরএডি) এক্সচেঞ্জের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমডিডি ডিভিশনের আওতায় মার্কেট অপারেশনস, প্রডাক্ট অ্যান্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট, ওটিসি মার্কেট ও রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ চার বিভাগের কার্যক্রম দেখভালের জন্য এমডিডি ডিভিশনে বর্তমানে কোনো মহাব্যবস্থাপক নেই। উপমহাব্যবস্থাপকের মাধ্যমে চলছে এ ডিভিশনের কার্যক্রম। গত মাসেই এ ডিভিশনের অধীন মার্কেট অপারেশনস ডিপার্টমেন্ট এসিআই ও ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ইউপিজিডিসিএল) মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশে ভুল করেছে।

ডিএসইর আরএডি ডিভিশনের আওতায় সার্ভিল্যান্স, মনিটরিং অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স, ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট, লিস্টিং অ্যাফেয়ার্স, ইনভেস্টর কমপ্লেইন্টস, আরবিট্রেশন অ্যান্ড লিটিগেশন এবং করপোরেট গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল রিপোটিং কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। এ বিভাগগুলোর সার্বিক কার্যক্রম দেখভাল করে থাকেন প্রধান রেগুলেটরি কর্মকর্তা (সিআরও) এ ডিভিশনে বর্তমানে কোনো মহাব্যবস্থাপক এবং উপমহাব্যবস্থাপক নেই। ফলে সিআরওর পর গুরুত্বপূর্ণ এ ডিভিশনের কার্যক্রম দেখভালে কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নেই। অথচ এ ডিভিশনের আওতায় থাকা বিভাগগুলোর মাধ্যমে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি, শেয়ারবাজারে নজরদারি, তদন্ত, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির সুশাসন নিশ্চিতের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে স্টক এক্সচেঞ্জের ওপর বাজার তদারকি ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিভিন্ন বিষয় দেখভালের জন্য আইনে নির্ধারিত যেসব দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেগুলো তারা ঠিকমতো পালন করতে পারছে না।

তাছাড়া ডিএসইর ফিন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগে বর্তমানে কোনো মহাব্যবস্থাপক নেই। ফলে প্রধান অর্থ কর্মকর্তার (সিএফও) পর ফিন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ডিভিশনের কার্যক্রম তদারকির জন্য কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নেই। তার ওপর ডিএসইর সিএফও আবদুল মতিন পাটোয়ারি বর্তমানে এক্সচেঞ্জটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বও পালন করছেন। দিন দিন স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এছাড়া ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার সাংহাই-শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ যেসব কারিগরি সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ডিভিশনকে। অথচ এ ডিভিশনটিতে বর্তমানে কোনো মহাব্যবস্থাপক নেই। প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) এ ডিভিশনের সবকিছু তদারক করছেন।

ডিএসইর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক্সচেঞ্জটির গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু পদে সিনিয়র কর্মকর্তা না থাকায় সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোতে যারা সিনিয়র আছেন তাদের ওপর একাধিক দায়িত্ব থাকায় ঠিকমতো সবকিছু দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না। ডিএসইর পর্ষদের কাছে বিভিন্ন সময় লোকবল নিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। নতুন লোকবল নেয়া হলে প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যাবে, এ কারণে পর্ষদ লোকবল নিয়োগের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রমে সিনিয়র কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেকোনো জটিল পরিস্থিতিতে অধস্তনদের সঠিক দিকনির্দেশনা সিনিয়র কর্মকর্তারাই দিয়ে থাকেন। ফলে সুষ্ঠুভাবে এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে সিনিয়র কর্মকর্তা থাকা আবশ্যক। ডিএসই কর্তৃপক্ষের উচিত বর্তমানে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি রয়েছে, সেখানে সিনিয়র কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা।

এদিকে শেয়ারবাজারের মন্দা পরিস্থিতি এবং ইকুইটির বাইরে আর কোনো বিকল্প পণ্য না থাকার কারণে ক্রমশই ডিএসইর আর্থিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর ধারাবাহিকভাবে এক্সচেঞ্জটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমছে। ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে ডিএসইর মুনাফা হয়েছিল ১৩৪ কোটি টাকা, এর পরের ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে মুনাফা ছিল ১৩৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে এক্সচেঞ্জটির মুনাফ হয়েছিল ১১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে মুনাফা ছিল ১২৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ডিএসইর মুনাফা হয়েছিল ১০৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর সর্বশেষ সমাপ্ত ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে এক্সচেঞ্জটির কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৯৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ডিএসইর পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদানের সুপারিশ করেছে। গতকাল এক্সচেঞ্জটির পর্ষদ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ডিএসইর ৫৮তম বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন সাপেক্ষে এ লভ্যাংশ বিতরণ করা হবে।

ডিএসইর গুরুত্বপূর্ষ পদে সিনিয়র কর্মকর্তা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সচেঞ্জটির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বণিক বার্তাকে বলেন, গতকালের পর্ষদ সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সবার আগে আমরা ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য আবারো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পর্যায়ক্রমে সব পদেই লোকবল নিয়োগ দেয়া হবে। আর এক্সচেঞ্জে পণ্যবৈচিত্র্য আনার জন্য স্মল ক্যাপ প্লাটফর্মটি চালুর জন্য আমরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এ মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে ন্যূনতম একটি কোম্পানিকে দিয়ে হলেও প্লাটফর্মটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন