মিলেনিয়ালরা বদলে দিচ্ছে আফ্রিকার কৃষি

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে গ্রামমুখী মিলেনিয়ালদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’—এ আপ্তবাক্য থোড়াই কেয়ার করছে তারা। তাদের একেকটি সফলতার গল্প বাকি তরুণদেরও উৎসাহিত করছে

বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার পর রীতিমতো গুম মেরে যান ভজবেথ কফি আজুমা। মনে মনে গুছিয়ে আনা পরিকল্পনার কথাটা তিনি মাকেও জানাননি। সম্প্রতি ঘানার আগোটাইম বেহ এলাকায় তার সদ্য কর্ষিত জমির পাশে মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন চালু রেখেই বলেন, আমি একজন কৃষক। এখানে এ পরিচয়টা কিন্তু বেশ অস্বস্তিকর। তিনি একজন সফল শামুক খামারি।

বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষককে খুব সম্মান করা হয়। কৃষিকাজ সম্মানজনক ব্যবসা হিসেবেই গণ্য করা হয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির কবলে ভাবমূর্তি সংকটে রয়েছে আফ্রিকার কৃষি। শিক্ষিত তরুণরা ছোটে চাকরির সন্ধানে নগরে। অভিভাবকরাও চান না সন্তান হালচাষ করুক। ফলে কৃষি এখানে দারিদ্র্যের প্রতীক হয়ে রয়েছে।

আজুমার মতো আফ্রিকার বিপুলসংখ্যক তরুণ এখন এ সামাজিক লজ্জার শিকল ভাঙতে শুরু করেছেন। এক অর্থে বাবা-মায়ের অবাধ্য এসব তরুণই এখন আফ্রিকায় কৃষিবিপ্লবের কাণ্ডারি।

তারা অবশ্য সেকেলে কৃষক নন। তারা সবাই কৃষিতে প্রয়োগ করছেন আধুনিক প্রযুক্তি, বিপুল তথ্যসমৃদ্ধ মোবাইল অ্যাপ। তাতে একদিকে বাড়ছে উৎপাদন, সেই সঙ্গে সহজ হয়েছে বিপণনও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে গ্রামমুখী মিলেনিয়ালদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’—এ আপ্তবাক্য থোড়াই কেয়ার করছে তারা। তাদের একেকটি সফলতার গল্প বাকি তরুণদেরও উৎসাহিত করছে।

অবশ্য বিতরণ নেটওয়ার্কের অভাব, রাস্তাঘাট ও সুবিধামতো স্থানে সেচের পানির সংকটএসব সমস্যার মধ্যে এ তরুণদের মাঠে নামতে হচ্ছে। তাছাড়া তাদের অধিকাংশেরই কৃষিকাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানও নেই। এদের একমাত্র ভরসা ইউটিউব আর বিভিন্ন ব্লগ।

আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বলছে, আফ্রিকার কৃষি ও সার্বিক রূপান্তরের চালিকাশক্তি এখন মিলেনিয়ালরা। এ প্রবণতাকে উৎসাহিত করতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৩৫ কোটি ডলার সহায়তা দেয়া হচ্ছে। উৎসাহী তরুণদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে এ অর্থ খরচ করা হচ্ছে।

এ তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা এখনএগ্রিপ্রেনিউর নামে অভিহিত হচ্ছেন। আফ্রিকা মহাদেশে অপুষ্টিতে ভোগা ২৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার কাজে যুক্ত হওয়াটাও একটি উজ্জ্বল কেরিয়ার হতে পারে, যা তরুণরা দেখিয়ে দিচ্ছে।

কৃষিতে ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি মহাদেশ আফ্রিকা। এডিবির হিসাবে পৃথিবীর মোট চাষযোগ্য অনাবাদি জমির ৬৫ শতাংশই রয়েছে আফ্রিকায়। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির বিপুল ভাণ্ডার এবং বছরে ৩০০টি রৌদ্র করোজ্জ্বল দিন।

এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালে আফ্রিকা মহাদেশকে ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের খাদ্য আমদানি করতে হয়েছে। এডিবির প্রেসিডেন্ট ড. আকিনউমি আদেসিনা বলেন, এটা কিন্তু ভঙ্গুর, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সামর্থ্যের বাইরের একটা ব্যাপার। তাছাড়া এটা সম্পূর্ণ অদরকারি।

আফ্রিকা মহাদেশেই বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ কোকো উৎপাদন হয়। অথচ বিশ্বব্যাপী চকোলেট বিক্রি থেকে আয়ের মাত্র ২ শতাংশ পায় এ মহাদেশ। ড. আদেসিনা বলেন, আফ্রিকার কৃষি সক্ষমতার সবটুকু কাজে লাগানো গেলে এ মহাদেশই হয়ে উঠবে খাদ্যপণ্যের প্রধান রফতানিকারক।

আফ্রিকার কর্মসংস্থানের ৬০ শতাংশই কৃষিকেন্দ্রিক। এ মহাদেশের কৃষি মূলত নারীদের হাতে। কেনিয়াভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানআফ্রিকান উইমেন এগ্রিবিজনেস নেটওয়ার্ক (এডব্লিউএএন)’ আফ্রিকার ২৭টি দেশের

কৃষিজীবী নারীদের নিয়ে কাজ করে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে তারা নারীদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়া ঘানার গুজাকুজা নামের একটি সংগঠন নারী চাষীদের নানাভাবে সহায়তা করছে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তারা স্থানীয় পুষ্টিচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তানজানিয়া, নাইজেরিয়া ও ইথিওপিয়ায় আন্তর্জাতিক এনজিও অক্সফামের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিতফিমেল ফুড হিরো ক্যাম্পেইন বহু মানুষকে উৎসাহিত করছে। তাদের একটি কৃষিবিষয়ক টিভি অনুষ্ঠান ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।


কৃষিকাজে তরুণদের টানতে এরই মধ্যে বেশকিছু তরুণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে একজন ঘানার রিচার্ড নুনেকপেকু। মোটা বেতনে স্যামসাংয়ে চাকরি করতেন তিনি। ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে আনায়াকো ফার্মস প্রতিষ্ঠা করেন। সেচ ও ফসল সংগ্রহে উচ্চপ্রযুক্তির প্রসারে কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠান।

এ তরুণদের অংশগ্রহণে আফ্রিকায় কৃষিপ্রযুক্তি একটি উদীয়মান খাতে পরিণত হয়েছে। গত বছর প্রযুক্তি পত্রিকা ডিজরাপ্ট আফ্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬-১৮ এ দুই বছরে কৃষিপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ডলারেরও বেশি। আর এ সময় স্টার্টআপের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও ঘানা। কৃষিঋণ, খামার তৈরিতে কারিগরি সহায়তা, ফসল উৎপাদনে পরামর্শ, ভাড়ায় কৃষি যন্ত্রপাতি, বিপণন এ ধরনের সেবা এখন কৃষকরা ঘরে বসেই তার সস্তা স্মার্টফোনটির মাধ্যমেই পাচ্ছেন।

এদিকে আফ্রিকায় কৃষিজীবীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমছে। বেশির ভাগ কৃষকই এখন বয়স্ক। এফএওর হিসাবে এ মহাদেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বয়স ২৪ বছরের নিচে। আর কৃষকদের গড় বয়স ৬০ বছর। শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত তরুণরা চাকরির খোঁজে ছুটছে নগরে, যেখানে বেকারত্ব এখন বাড়ছে রকেট গতিতে।

দীর্ঘমেয়াদে আফ্রিকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য কৃষি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বুঝতে পারছে এখনকার তরুণরা। নিজেদের দেশকে খাদ্যে আমদানিনির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে কোমর বেঁধে নেমেছেন বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ। এ ধরনের উদ্যোক্তার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

অনেক শিক্ষিত তরুণ আস্তিন গুটিয়ে নেমে পড়ছেন চাষাবাদে। তবে এর মধ্যে জমি ইজারা নেয়া, চাষের ট্রাক্টর কেনা এবং বড় ধরনের লোকসান ঝুঁকি সামাল দেয়ার মতো সামর্থ্য আছে এমন তরুণরাই মূলত কৃষিতে আসছেন। ইউটিউব জ্ঞানের ওপর ভরসা করে তারা জমি চাষ, হাঁস-মুরগি পালনের মতো উদ্যোগ নিচ্ছেন।

এদের মধ্যে ঘানার ইমানুয়েল আনসাহ আমপ্রোফির গল্পটা চমত্কার। কয়েক বছর আগেও তিনি অভিবাসন নিয়ে কাজ করতেন। স্থানীয় বাজারে যাতায়াতের সুবাদে আবিষ্কার করলেন এখানে পেঁয়াজ আসে হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস) থেকে।

৩৯ বছর বয়সী এ যুবক বলেন, এটা জানার পর আমার দেশের প্রতি খুব রাগ হলো। রাস্তায় অসংখ্য তরুণ যুবক বেকার ঘুরছে, আর আমরা এত সবজি আমদানি করছি? এত এত জায়গাজমি, চমত্কার আবহাওয়া, বিপুল জলাশয় নিয়ে আমরা কী করব তাহলে? এ ভাবনা মাথায় আসার পরই সোজা বাড়িতে গিয়ে গুগলে অনুসন্ধান শুরু করলাম কীভাবে চাষাবাদ করা যায়।

এর দুই বছর পর ২০১৬ সালে ইমানুয়েল শুরু করেন নানা সবজি আর ফল চাষ। এর মধ্যে খোঁজ পেয়ে যান ট্রট্রো ট্রাক্টর নামে ট্রাক্টর ভাড়া নেয়ার অ্যাপ। ফলে চাষাবাদ আরো সহজ হলো তার।

অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক আজুমার (২৭) ভাগ্য খুলেছে আফ্রিকান জায়ান্ট র্যাট (ইঁদুর) আর জায়ান্ট শামুকে। বনজঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে এনে পেলেপুষে বড় করেন তিনি। বাজারে বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়।

এ কথা প্রথম যখন মাকে জানান আজুমা, তখন তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলেন। আজুমার মা মার্থা বলেন, আমি খুব কেঁদেছিলাম। আমার আশা ছিল, ছেলে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সুট-টাই পরে একটা অফিসে চাকরি করবে। সে কিনা চাষা হয়ে গেল! বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গাটাকেই শামুকের খামার বানিয়েছেন আজুমা। এখন তাকে নিয়ে গর্ব করেন মা মার্থা। এখন তিনি বলেন, অনেক চাকুরে আছে, যারা বড় বড় অফিসে কাজ করে অথচ বেতনটা ঠিকমতো পায় না। আজুমা এখন শামুক চাষে অনলাইনে প্রশিক্ষণও দেন।

তরুণদের এ আগ্রহে প্রণোদনা দিচ্ছে আফ্রিকার সরকারগুলোও। যেমন ঘানা সরকার ২০১৭ সাল থেকে গ্রামীণ উন্নয়নে কৃষিতে জোর দিচ্ছে। ২ হাজার ৭০০ জনের বেশি কৃষি কর্মকর্তা এখন কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করছেন। তারা কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন।

কৃষি নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে যুক্ত করা হচ্ছে সেলিব্রিটিদের। একটি জনপ্রিয় পপগানের মিউজিক ভিডিওতে দেখানো হয়েছে মডেল চড়ছেন ট্রাক্টরে, শিশুদের কৃষিকাজে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি টেলিভিশনে চলছে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন রিয়েলিটি শো।

 

জাহাঙ্গীর আলম

সূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, নিউইয়র্ক টাইমস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন